‘নালার কাছে এলে মনে হয় বাবা এখানেই আছেন’
২৪ আগস্ট ২০২৩ ১৯:০৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট। চট্টগ্রাম জুড়ে প্রবল বর্ষণ। পানিতে তলিয়ে গেছে বন্দরনগরী। সেই ঝড়-জলকে সঙ্গী করেই জীবিকার তাগিদে পথে নেমেছিলেন সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ। নগরীর মুরাদপুরে ছাতা হাতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। পানির নিচে হা করে আছে প্রকাণ্ড নালা, গ্রোগ্রাসে গিলে নেওয়ার অপেক্ষায়, বুঝতে পারেননি তিনি। অসতর্কতাবশত পড়ে যান নালায়, মুহূর্তেই প্রচণ্ড স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যায়।
সেই মর্মান্তিক ঘটনার দুই বছর হয়ে গেল। মাইলের পর মাইল খাল-নালায় কত খোঁজাখুঁজি, সালেহ আহমেদকে আর পাওয়া যায়নি। স্বজনদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না, হাহাকারেরও। আর এখনও নালার পাশে দাঁড়িয়ে বাবার স্মৃতি খুঁজে বেড়ান একমাত্র ছেলে সাদেকুল্লাহ মহিম।
বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) বিকেলে মুরাদপুরে সেই ঘটনাস্থলে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন সাদেকুল্লাহ মহিম। বললেন, ‘সবাই তার বাবার কবর জিয়ারত করতে পারে, কিন্তু সেই সুযোগ আমার নেই। বাবার কবরের পাশে গিয়ে যে দোয়া করব, মাগফিরাত কামনা করব- সেই সুযোগ পর্যন্ত নেই। এটা আমার দুর্ভাগ্য। এখনও নালার কাছে এলে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি, মনে হয় বাবা এখানেই আছেন।’
ঘটনাস্থলেই সংবাদ সম্মেলনে সাদেকুল্লাহ মহিম তার বাবার নিখোঁজের জন্য আবারও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘এর জন্য সিটি করপোরেশন ও সিডিএ দুই সংস্থাই দায়ী। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তদন্ত কমিটি পাঠানো হয়েছিল। এরা তদন্ত করে দুই সংস্থাকে দায়ী করেছে। যদি নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকতো তাহলে এই ঘটনা ঘটতো না।’
যাদের অবহেলায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসার উপক্রম, সেই দুই সংস্থা চসিক ও সিডিএ গত দেড় বছর ধরে কোনো খোঁজ নেয়নি বলে অভিযোগ করেন সাদেকুল্লাহ মহিম।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের ২৫ আগস্ট আমার বাবা সালেহ আহমদ পা পিছলে নালায় পড়ে যান। অনেক দিন হয়ে গেলেও তার লাশের সন্ধান এখনও আমরা পাইনি। দুই বছর হয়ে গেল। চসিক মেয়র আমাকে একটি চাকরির আশ্বাস দিয়েছিলেন। কী চাকরি দেবে সেটা বলেননি।’
‘তিনমাস পর পেট্রোল পাম্পের শ্রমিক হিসেবে একটি চাকরি দেয়। আমি তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। একাদশ শ্রেণিতে পড়ে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করে সেই চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। বলতে গেলে দু’টার কোনোটাই সম্ভব হচ্ছিল না। আমি মেয়রকে অনেকবার অনুরোধ করেছিলাম চাকরিটা পরিবর্তন করার জন্য। সিটি করপোরেশনের কোনো স্থায়ী বা পিয়ন পদেও চাকরি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু কোনো কিছু হয়নি। পরে আমি ওই চাকরি ছেড়ে দিই।’
সিডিএ থেকে এখন পর্যন্ত খোঁজই নেওয়া হয়নি অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আজ দেড় বছর পর এখন পর্যন্ত মেয়র একবারও খবর নেননি। সিডিএ তো কোনো খবরই নেইনি। চাকরি ছাড়ার এক বছর পর ক্ষতিপূরণের জন্য আমি উচ্চ আদালতে রিট করেছি। হাইকোর্ট চার সপ্তাহের রুল দিয়েছিল। রুলের পর তাদের হাইকোর্ট থেকে নোটিশ দেওয়া হয়। দুই সংস্থা নোটিশের জবাব দেয়নি। হাইকোর্ট তিনবার নোটিশ পাঠানোর পর মামলার ফাইল রেডি করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটি দাবি থাকবে, যেন আমাদের এই ব্যাপারটা তিনি সুরাহা করে দেন। সঠিক তদন্ত করে যাতে বিচার করেন।’
মহিম বলেন, ‘পরিবারে আমার বোন, মা আর আমি আছি। বাবাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আত্মীয়স্বজনদের সহযোগিতায় কোনোভাবে আমাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। খুব কষ্ট করে দিন যাপন করতে হচ্ছে আমাদের।’
২০২১ সালের ২৫ আগস্ট দুপুরে মুরাদপুর মোড়ে পা পিছলে নালায় পড়ে যান সালেহ আহমদ। ছাতা হাতে রাস্তা পারাপারের সময় সেকেন্ডের মধ্যেই নালার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা সিসিটিভি ফুটেজে ধারণ হয়। সেই ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল কয়েকদিন ধরে তল্লাশি চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আইসি/আরডি/পিটিএম