রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর: প্রত্যাবাসন এখনো সুদূর পরাহত
২৫ আগস্ট ২০২৩ ০০:৩১
ঢাকা: ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুরু হয় দেশটির সামরিক বাহিনীর চূড়ান্ত নির্যাতন। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন— বাদ পড়েনি কিছুই। বাধ্য হয়ে প্রাণ বাঁচাতে নিজ ভূমি থেকে পালাতে শুরু করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কাঁটাতারের বেড়া আর নো-ম্যান্স ল্যান্ড পেরিয়ে এসে ঠাঁই নেন বাংলাদেশে। এভাবেই বছরখানেকের মধ্যেই একে একে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর গত ছয় বছর ধরে তারা রয়েছেন এই দেশেই। তাদের একজনকেও নিজ দেশে ফেরানো সম্ভব হয়নি।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়, সেটিকে ‘জাতিগত নির্মূলের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ (টেক্সবুক এক্সাম্পল অব এথনিক ক্লিনজিং) বলে আখ্যা দিয়েছিল জাতিসংঘ। গোটা বিশ্ব সেই নির্যাতনের চূড়ান্ত নিন্দা জানিয়েছে। ওই সময় মানবিক বিবেচনাতেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ সরকার। একটা সময় মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। শুরু হয় রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে ফেরানোর আলোচনা। কিন্তু গত ছয় বছরে সেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে নিকট ভবিষ্যতেও এই প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হবে বলে আশা করছেন না কেউ।
সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গাদের ঢল নামলে কক্সবাজারের উখিয়া, কুতুপালংসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠে অস্থায়ী রোহিঙ্গা শিবির। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তৎপরতায় রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ছয় বছর পর সেই ক্যাম্পগুলোই যেন রোহিঙ্গাদের স্থায়ী আবাসে পরিণত হয়েছে। প্রত্যাবাসনের আলোচনা শুরুর পর একাধিক উদ্যোগ নিলেও তা ভেস্তে গেছে।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার মাসখানেক পর থেকেই প্রত্যাবাসন নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। ওই বছরের ১৮ অক্টোবর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি জানান, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে ঢাকাকে সহায়তা করতে প্রস্তুত বেইজিং। তার এমন বক্তব্যের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রথম আশার আলো দেখতে শুরু করেন সবাই।
ওয়াং ই’র সফরের পাঁচ দিনের মাথায় ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। এতে বলা হয়, মিয়ানমার প্রতিদিন ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেবে। শুরু হওয়ার দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন শেষ হবে।
সমঝোতা চুক্তির পর অবশ্য প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া বেশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের কাছে আট হাজার রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করে ফেরত পাঠানোর জন্য। সেই তালিকা থেকে মাত্র ৩৭৪ জনকে নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। সেই ৩৭৪ জনকে রাখাইনে পাঠানোর তারিখ শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয় ওই বছরের নভেম্বরে। কিন্তু ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাবাসনের প্রথম প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। ওই তালিকার রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর দ্বিতীয় প্রচেষ্টাটিও একইভাবে ব্যর্থ হয় ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার দুই বছর পূর্তির দিনে কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা বিশাল সমাবেশ করেন। সেখানে তারা বলেন, মিয়ানমার নাগরিকত্বসহ পাঁচ দফা দাবি রয়েছে তাদের। সেগুলো পূরণ না করা পর্যন্ত তারা রাখাইনে ফিরে যাবে না। ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আরও যতগুলো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ভেস্তে গেছে তার সব উদ্যোগই। এর মধ্যে মানবাধিকাকর্মীসহ বিভিন্ন সংস্থা রাখাইন পরিদর্শন করে জানিয়েছে, সেখানকার পরিবেশ এখনো রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ নয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পও পরিদর্শন করেন তিনি। পররাষ্ট্র সচিব ছাড়াও সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। আজরা জেয়া ওই সময় রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বাড়ানোর কথা জানান। একইসঙ্গে এ-ও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকলেও এখনো রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
এ সপ্তাহ দুয়েক পরে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রতিনিধি দল। রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনের কমিশনের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিনিধি দলটি। এই দলে ছিলেন ইইউয়ের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনার ঘটনা উল্লেখ করে গিলমোর গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার কাউন্সিলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবু মিয়ানমারে পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য তারা কাজ করছেন।
এর আগে গত মে মাসে রোহিঙ্গাদের একটি দল প্রথমবারের মতো রাখাইন রাজ্যে যায়। সেখানে তাদের ফেরা ও বসবাসের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে কি না— সেটি দেখতেই গিয়েছিলেন তারা। তবে কক্সবাজারে ফিরে আসার পর তাদের কেউ আর মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নন বলে জানান। বলেন, সেখানে তারা কোনোভাবেই নিরাপদে থাকবেন না এবং থাকার মতো কোনো পরিবেশও সেখানে নেই।
সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যেও প্রত্যাবাসন দিয়ে বিভক্তি রয়েছে। একটি পক্ষ প্রত্যাবাসনের পক্ষে শক্তভাবে অবস্থান নিলেও অন্য পক্ষ কোনোভাবেই মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নয়। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের এই সংগঠনটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, বাংলাদেশের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের দেশে ফিরতে চাই। আমাদের শিশুদের নিজ ভূমিতে বেড়ে উঠতে দেখতে চাই। আন্তর্জাতিক সব পক্ষের প্রতি আমরা আহ্বান জানাই, আমাদের প্রত্যাবাসনে সহায়তা করা হোক।
অন্যদিকে ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আমরা মিয়ানমার গিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর পর নিজেদের ভূমি দেখেছি। কিন্তু আমাদের নাগরিকত্ব না দিলে সেখানে মেহমানের মতো যেতে পারব না। আমাদের দাবি, আমাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে হবে, আমাদের ভিটেমাটি ফিরিয়ে দিতে হবে। নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, ভিটেমাটি না দিলে আমরা যাব না।
এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বরাবরই তাগিদ দিয়ে আসছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কাউকে যেন জোর করা না হয়। সংস্থাটির বক্তব্য, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অবশ্যই স্বেচ্ছায় হতে হবে এবং সেটি হতে হবে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শিগগিরই শুরু করা যাবে, সে বিষয়ে আশাবাদী হতে পারছেন না বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাবে। মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সরকার দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। আলোচনা চলছে। আমরা সবসময় আশাবাদী।’
সারাবাংলা/টিআর
রাখাইনে নির্যাতন রোহিঙ্গা রোহিঙ্গা ক্যাম্প রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গা সংকট