বেপরোয়া রোহিঙ্গা: ৬ বছরে ৩০২০ মামলায় আসামি ৬৮৩৭
২৫ আগস্ট ২০২৩ ০৯:০০
কক্সবাজার: মিয়ানমারের রাখাইন থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার শুরুটা আজ থেকে ছয় বছর আগের ঠিক এই দিনে। নিজ দেশে সরকার আর সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা ঠাঁই পেয়েছিলেন কক্সবাজারে।
বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে সরকার এবং ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলোও তাদের সহায়তা করতে পাশে দাঁড়ায়। তাতে জীবনধারণের জন্য প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই পেয়েছেন রোহিঙ্গা নাগরিকরা। তা সত্ত্বেও গত ছয় বছরে তারা আশ্রয় শিবির ও শিবিরের বাইরে জড়িয়ে পড়েছেন নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। তাদের এমন আচরণ কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনকেও প্রভাবিত করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ক্যাম্পগুলোতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অনেকেই এ দেশের আইন-কানুন মানছেন না। অনেকেই চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন ক্যাম্প থেকে। মাদক, চুরি-ডাকাতি, মারামারি থেকে শুরু করে ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা, মানবপাচারের মতো নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে কেউ কেউ বাংলাদেশের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে নিচ্ছেন।
এসব রোহিঙ্গাদের অনেকেই ব্যবহৃত হচ্ছেন কিলিং মিশনে। ফলে ক্যাম্প ও এর আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। ঝুঁকিতে পড়ছেন স্থানীয়রা।
পুলিশ ও প্রশাসনের তথ্য বলছে, গত ছয় বছরে ছয় হাজার ৮৩৭ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করে মামলা হয়েছে তিন হাজার ২০টি। গড়ে বছরে মামলার সংখ্যা প্রায় ৫০০। এমন প্রেক্ষাপটেই রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে পালানো বা বের হওয়া ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। সব পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও অনুপ্রবেশ ঠেকানোসহ ১২ সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা অপরাধে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ২০টি। আর এসব মামলায় আসামি ছয় হাজার ৮৩৭ জন। এসব মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ৫৭টি মামলা মাদক আইনের। আসামি দুই হাজার ৯৭৯ জন। এছাড়া ২৩৮টি অস্ত্র মামলায় আসামির ৫৫২ জন, ১৩১টি হত্যা মামলায় আসামি ৯৯১ জন।
ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ৯৪টি মামলায় আসামি ১৪৪, ডাকাতির অভিযোগে ৬২ মামলায় আসামি ৫০৫ জন। রয়েছে অপহরণের মামলাও। ৪৪ মামলায় আসামি ২২২ জন। ৪২টি ফরেনার্স এ্যাক্ট মামলায় আসামির সংখ্যা ১০৪ জন, ৩৭টি মানবপাচার মামলায় আসামির সংখ্যা ১৮৯ জন ও ২৪৩টি অন্যান্য মামলায় আসামির সংখ্যা ৯৪১ জন।
অন্যদিকে গত ছয় বছরে রোহিঙ্গাদের দ্বারা পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এরকম ঘটনায় সাতটি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৭৭ জন রোহিঙ্গাকে।
রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন ব্যবস্থায় এমন কোনো অপরাধ নেই যা রোহিঙ্গারা করছেন না। স্থানীয়দের টার্গেট কিলার হিসেবেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি সবার জন্য উদ্বেগজনক।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গারা হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, মানবপাচার ও আধিপত্য বিস্তারসহ ১৪ ধরনের অপরাধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। অল্প জায়গায় বহু মানুষের বসবাসের কারণে রোহিঙ্গারা মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে দেশের প্রচলিত আইন রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পেছনে অবৈধভাবে ক্যাম্প থেকে বের হওয়া সুযোগকে অন্যতম মূল কারণ মনে করা হয়। তাই রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। গত বুধবার দুপুরে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উখিয়ার পালংখালী বিওপির অধীন রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প-১৭-এর এ-ব্লকে আরসিও কার্যালয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সভা হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসমালের সভাপতিত্বে সভায় ১২টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানোর পর আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি সমন্বয় করা, নিয়মিত পুলিশ টহল ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা, মাঝিদের কার্যক্রম বাড়ানো ও অপরাধ কর্মকাণ্ডে তাদের নজরদারি রাখার মতো বিষয়গুলো নিয়ে সভায় আলোচনা করা হয়।
রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে চেকপোস্ট বাড়ানো, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা, সীমান্ত উত্তেজনায় অনুপ্রবেশ ঠেকানোসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো, স্থানীয় দুষ্কৃতকারীদেও সাথে আরসা সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ, জিরো পয়েন্টে সন্ত্রাসীদের অবস্থান— এসব বিষয়ও গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয় সভায়।
উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আশা করছেন, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা গেলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনেকটাই কমে আসবে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাটের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। কয়েক মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশে চলে আসেন ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঠাঁই হয়েছে তাদের।
সারাবাংলা/এনইউ/টিআর