‘কূটনৈতিক ব্যর্থতায় রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপন করছে’
২৫ আগস্ট ২০২৩ ২২:৩৮
ঢাকা: বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘দীর্ঘ ৬ বছর পার হল রোহিঙ্গা সমাধানে সরকার কিছু করতে পারেনি। সরকারের ধারাবাহিক কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং সদিচ্ছার অভাবে রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপন করছে।’
শুক্রবার (২৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর সংগঠিত ইতিহাসের অন্যতম গণহত্যার ৬ষ্ঠ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
রিজভী বলেন, ‘মিয়ানমারের সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। দীর্ঘ ৬ বছর হয়ে গেল, অথচ এর কোনো সমাধান সরকার করতে পারেনি। জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার উভয় বিএনপি সরকারের সময় মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে গ্রহণ করা হয়। শুধু তাই নয়, অচলাবস্থা কাটিয়ে নিশ্চিত করা হয় নিজ দেশে তাদের সময়োপযোগী প্রত্যাবর্তন।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির প্রতিটি সরকারের সময় বাংলাদেশে শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়ই দেওয়া হয়নি, বহির্বিশ্বের অনুদানের ওপর নির্ভর না করে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে প্রদান করা হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, গড়ে তোলা হয় পরিবার ও পরিবেশ বান্ধব জীবনব্যবস্থা।’
রিজভী বলেন, ‘জিয়াউর রহমান নিজে ইয়াঙ্গুন গিয়ে তৎকালীন বার্মা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন সেই দেশের নাগরিকদের ফেরত নেওয়ার জন্য। পাশাপাশি জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করেন জোরালো ভূমিকা পালনে। ফলস্বরূপ, ১৯৭৮ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশের সঙ্গে বার্মার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। এক বছরের মধ্যে এক লাখ পাঁচ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে বার্মায় ফেরত পাঠানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাস্তবসম্মত ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাপান ও গণতন্ত্রের পক্ষের প্রতিটি বৈশ্বিক শক্তি যে জোরালো ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে, এ দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তার জন্য কৃতজ্ঞ।’
রিজভী বলেন, ‘গত কয়েক বছরে রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও রাষ্ট্র মিলে এই আর্থিক সহায়তার পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, বা ৫০ হাজার কোটি টাকা। দাতা দেশ ও সংস্থার দেওয়া বিপুল এই অর্থের একটি বড় অংশ অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার সরাসরি খরচ করছে নানান প্রকল্প ও খাতের নামে। লাগামহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব বৈদেশিক সহায়তার কতটুকু সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, অস্বচ্ছ ও জবাববিহীন প্রক্রিয়ায় খরচ হওয়া সেই অর্থ আদৌ রোহিঙ্গারা পাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘মাফিয়া আওয়ামী লীগ সরকার যে অস্বাস্থ্যকর, অনিরাপদ ও অবর্ণনীয় পরিবেশে শরণার্থীদের দেশের বিভিন্ন ক্যাম্প ও স্থানে রাখছে, তা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। সেখানে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। স্বনির্ভরতা বা কর্মব্যবস্থার সুযোগ নেই। মানবিক মর্যাদা বা সামাজিক সুবিচার নেই। স্বভাবতই, তাদের জীবনে বিরাজ করছে অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা ও অচলাবস্থা।’
রিজভী বলেন, ‘দেশে-বিদেশে গণতন্ত্রের পক্ষের সকল শক্তির ক্রমাগত আহ্বান সত্বেও, ফ্যাসিস্ট সরকার রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার হরণ করে চলেছে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়, নিজ স্বার্থে শেখ হাসিনা একদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে নাগরিক প্রত্যাবাসনে বার্মাকে চাপ দিতে অপারগ ও অনিচ্ছুক অন্যদিকে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে তার অনুগত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনে।’
তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২২ সালে অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী নিহত হয়েছে এবং এই সংখ্যাটি বেড়ে ২০২৩ সালের জুলাইয়ের মধ্যেই ৪৮টি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গত ছয় বছরে ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। ক্যাম্পের ভেতর সরকারি দলের রাজনৈতিক মদদে একদিকে যেমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে, তেমনি স্বেচ্ছাচারী আইন শৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করেছে। এসব নিপীড়নের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।’
রিজভী বলেন, ‘জাতিসংঘের শরনার্থী সংস্থা, ইউএনএইচসিআর, ২০২১ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংস আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানায়। এই হামলায় কমপক্ষে ৭ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় এবং শিশুসহ অনেকে হতাহত হন। রিলিফওয়েবের ১০ আগস্ট ২০২৩ এ প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই নির্যাতন স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পুলিশ দিয়ে রোহিঙ্গাদের নানাভাবে গ্রেফতার এবং অত্যাচার করে অর্থ আদায়ের ঘটনাও উঠে এসেছে এই মাসে প্রকাশিত ফরটিফাই রাইটসের সর্বশেষ প্রতিবেদনে। কিন্তু এসব ঘটনার বিচার করতে অনিচ্ছুক অনির্বাচিত সরকার।’
তিনি বলেন, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বরাতে জানা যায়, সরকার নানা সময় ক্যাম্পের অন্তত ৩০টি স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে, অথচ রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে শিক্ষার বিকল্প নেই। এছাড়া ২০১৯ সাল থেকে দীর্ঘদিন ক্যাম্পগুলোতে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, যার ফলে শরনার্থীদের জন্যে কাজ করা সংস্থাগুলো তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।’
‘বিশেষ করে সেখানে করোনাকালীন ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম এবং করোনা বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে ইন্টারনেটের ব্যবহার মারাত্মকভাবে জরুরি ছিল। সেই সময়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংস্থাও এই শাটডাউনের প্রতিবাদ জানিয়েছিল’— বলেন রিজভী।
তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এটি আজ স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের কোটি—কোটি সাধারণ মানুষ যেমন আওয়ামী অপশক্তির ধারাবাহিক নিপীড়নের শিকার, তেমনি নির্যাতনের শিকার হতভাগ্য রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশের নাগরিকদের মতোই তারাও শিকার সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও জুলুমের।’
রিজভী বলেন, ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবসে আমরা দাবি জানাচ্ছি, শরণার্থীদের ওপর হওয়া জনবিদ্বেষী সরকারের সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আন্তর্জাতিক অংশীদার, উন্নয়ন সহযোগী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরামর্শ আমলে নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুষ্ঠু জীবনযাপন নিশ্চিতকরণ ও তাদের নিজ ভূমিতে পাঠানোর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও অমানবিক নিপীড়ন প্রমাণ করে যে, এ ধরনের আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবেলায় এই সরকার অপারগ ও ব্যর্থ। কেবল জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকারই পারে দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থনের ভিত্তিতে শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান করতে।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিমসহ অনেকে।