পুলিশবক্সে হামলা, ‘নব্য জেএমবির’ ১৫ সদস্যের বিচার শুরু
২৮ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৫৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে পুলিশ বক্সে বোমা হামলার মামলার আসামি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘নব্য জেএমবির’ ১৫ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়েছে।
সোমবার (২৮ আগস্ট) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুল হালিম আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি রুবেল পাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ৬ (২), ৮, ৯, ১০ ও ১২ ধারায় ১৫ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত। ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। ১৫ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা ১১ জন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে থাকা ২ জনসহ মোট ১৩ জন অভিযোগ গঠনের শুনানিতে হাজির ছিলেন। দুই আসামি এখনও পলাতক।’
আসামিরা হলেন- নব্য জেএমবির স্থানীয় গ্রুপের আমির মো. নোমান খান, স্থানীয় গ্রুপের সামরিক কমান্ডার এবং পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ মো. সেলিম, দাওয়াতি শাখার প্রধান জহির উদ্দিন এবং সদস্য মহিদুল আলম, মঈনউদ্দিন, আবু সাদেক, রহমতউল্লাহ আকিব, মো. আলাউদ্দিন, মো. সাইফুল্লাহ, মো. এমরান, মো. শাহেদ, মো. কাইয়ূম, মুহাম্মদ কায়ছার, মোরশেদুল আলম এবং মুহাম্মদ শাহজাহান।
আসামিদের মধ্যে মোরশেদুল আলম ও মুহাম্মদ শাহজাহান পলাতক আছেন। মহিদুল আলম ও মো. শাহেদ জামিনে থাকলেও শুনানিতে হাজির ছিলেন।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর ২ নম্বর গেইট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে দুই পুলিশ সদস্যসহ অন্তত পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার টহল পরিদর্শক (টিআই) অনিল বিকাশ চাকমা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় গুহ।
ঘটনার পর তদন্তকারী সংস্থা নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট হামলার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের বিভিন্নধাপে সম্পৃক্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করে। বোমা হামলার তিনমাস পরেই ২০২০ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র এমরান, পলিটেকনিকের ছাত্র আবু ছালেহ এবং দোকানকর্মী সাইফুল্লাহ- এ তিনজনকে গ্রেফতারের পরই কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট হামলার সঙ্গে নব্য জেএমবির সম্পৃক্ততার তথ্য পায়।
এরপর ওই বছরের অক্টোবরে নব্য জেএমবির ওই গ্রুপের দাওয়াতী শাখার প্রধান জহিরসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ গ্রুপের সামরিক কমান্ডার সেলিমকে গ্রেফতারের পর পুলিশ বক্সে বোমার হামলার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের পুরো ছক উদঘাটন করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
আড়াই বছর তদন্তের পর ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর তদন্তকারী কর্মকর্তা পৃথক দু’টি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। এর মধ্যে একটি অভিযোগপত্রে ১৫ জনকে আসামি করা হয়, যার বিচার শুরু হয়েছে সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালে। হামলার ঘটনায় ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরের সম্পৃক্ততার তথ্যপ্রমাণ পেয়ে তার বিরুদ্ধে আলাদাভাবে শিশু আইনে দোষীপত্র দাখিল করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রুবেল পাল সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, শিশু আইনে দোষী শনাক্ত হওয়া কিশোরের বিচার আলাদাভাবে অন্য আদালতে হবে।
কেন এই হামলা- কি আছে অভিযোপত্রে
অভিযোগপত্রে আসামিদের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘নব্য জেএমবির’ সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশে শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠায় ‘মূল বাধা’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ভেঙে দিতে নব্য জেএমবির সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে পুলিশ সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে ট্রাফিক বক্সে হামলা করা হয়েছিল বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। তবে এই হামলার মূল নির্দেশদাতা কে, সেটি তদন্তে উঠে আসেনি। এতে সাক্ষী হিসেবে আছেন ৪৭ জন।
অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, গ্রেফতার ১৩ জনের মধ্যে ৯ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৬ জন আসামিসহ মোট ২০ জনের একটি গ্রুপ চট্টগ্রাম নব্য জেএমবির কার্যক্রম শুরু করে। সামরিক কমান্ডার সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপসে ‘বড় ভাইদের’ সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। দাওয়াতি শাখার প্রধান জহির চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া বাজারের হকার্স মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারি ছিলেন। সেলিমের মাধ্যমে নোমান ও জহির এই সংগঠনের যুক্ত হয়। ২০১৭ সালে ইউটিউবে লাদেন, মোল্লা ওমর, তামিম আল আদনানি, আব্দুর রহমান, কাজী ইব্রাহিম ও জসিম উদ্দিন রাহমানির ওয়াজ শুনে তারা জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়। সেলিম হোয়াটস অ্যাপে জিহাদি ভিডিও পাঠিয়ে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করত।
২০১৮ সালে জহির তার বন্ধু শাহজাহান, নোমান, মোরশেদুল ও সেলিমকে নিয়ে পদুয়া বাজারের পূর্বদিকে ফরিয়াদির কূলে বেড়াতে যায়। সেখানে সেলিম প্রস্তাব দেয়, প্রতি সপ্তাহে কোরআন হাদিসের আলোকে গ্রুপ মিটিংয়ের। এরপর থেকে তারা সবাই একসঙ্গে ফজরের নামাজে পড়তে শুরু করে। নামাজ পড়তে গিয়ে আলাউদ্দিন, আকিব ও হাবিবকে নিজেদের গ্রুপে টেনে নেয়। কিছুদিন পর শাহজাহান দুবাই চলে যায়।
২০১৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে একদিন জহির ফরিয়াদির কূলে গিয়ে দেখতে পায়- নোমান, আলাউদ্দিন, হাবিব, শহিদ, সাহেদ, কাইছার, সাদেক ও কামাল পাহাড়ের মধ্যে গাছে আরবি লেখা কালো পতাকা বেঁধে সেলিম তাদের বায়াত (শপথ) করাচ্ছে। জহির বায়াতে ছিল না। তবে সবাই মিলে একসঙ্গে ছবি তোলে। জহিরের মোবাইল থেকে সব ছবি সেলিম নিয়ে নেয়।
উল্লেখ্য, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের ২ নভেম্বর সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে জঙ্গলঘেরা একটি এলাকায় বায়াত নেওয়ার সময় মুখে ও মাথায় কাপড়বাঁধা নয় যুবকের একটি ছবি প্রকাশ করে।
অভিযোগপত্রের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে জহির দাওয়াত দিয়ে মহিদুল আলম ও মঈনউদ্দিনকে গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে। সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে ‘বড় ভাইদের’ সঙ্গে যোগাযোগের পর নোমান খানকে আমির, নিজেকে সামরিক শাখার প্রধান এবং জহিরকে দাওয়াতি শাখার প্রধান ঘোষণা করে। টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে ‘বড় ভাইদের’ সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি মূলত সেলিম একাই করত। তাদের নির্দেশের কথা জানিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জহির, নোমান ও মোর্শেদকে ডেকে সেলিম নির্দেশ দেয়- পুলিশ বক্সে হামলা করতে হবে। এরপর সেলিম নিজেই হাবিব, শাহেদ, কাইছার, আবু সাদেক, সাইফুল ও এমরানকে নিয়ে দল তৈরি করে।
সেলিম আইইডি (বোমা) তৈরির পিডিএফ ফাইল মোবাইল ফোনের সাহায্যে সদস্যদের সরবরাহ করে। মঈনউদ্দিন, রহমত ও আইয়ূব জিআই পাইপ দিয়ে আইইডি বানিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায় পরীক্ষামূলকভাবে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সেলিম পুলিশ বক্সে হামলার জন্য জহির, নোমান ও মোরশেদুলকে নির্দেশ দেয়। ফেব্রুয়ারি মাসে সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে ‘সরকারি বাহিনীকে মারতে হবে’ মর্মে নির্দেশ পাবার কথা আলাউদ্দিনকে জানায়।
ঘটনার দিন অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে একটি আইইডি (বোমা) নিয়ে সেলিম, সাদেক, কাইছার, হাবিব ও শাহেদ লোহাগাড়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসে। নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেট এলাকায় সাইফুল্লাহর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। সাইফুল্লাহ সেলিমকে নাসিরাবাদের আপন নিবাসের গিরি ভবনে এমরানের বাসায় নিয়ে যায়। চবি ছাত্র এমরান সেখানে ব্যাচেলর বাসায় ভাড়া থাকত। সেলিম কীভাবে আইইডি’র বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে সেটি শিখিয়ে দেয় এমরানকে। সেলিম সেখানে আইইডি রেখে সাইফুল্লাহকে নিয়ে বের হয়। জুমার নামাজের পর সেলিম ও সাইফুল্লাহ মিলে নগরীর বিভিন্ন এলাকা রেকি করে দুই নম্বর গেইটে ট্রাফিক বক্স হামলার জন্য নির্ধারণ করে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সময় আবু সাদেক ট্রাফিক বক্সের ভেতরে টেবিলের নিচে আইইডি রেখে আসে। সেলিমের নির্দেশ অনুযায়ী- এমরান ও সাইফুল্লাহ বিস্ফোরণ ঘটানোর দায়িত্বে ছিল। এমরানের হাতে ছিল রিমোট কন্ট্রোলার। কিন্তু সাইফুল্লাহ ট্রাফিক বক্সের দক্ষিণে যাত্রী ছাউনির পাশে দাঁড়িয়ে রিমোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর সেলিমকে ফোন করে সাইফুল্লাহ বলে- আমরা সফলভাবে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি। এরপর শুধুমাত্র এমরানকে শহরে রেখে বাকি সবাই লোহাগাড়ার পদুয়ায় চলে যায়।
সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপে কার কাছ থেকে পুলিশ বক্সে বোমা হামলার নির্দেশ পেয়েছেন- সেটা অভিযোগপত্রে উল্লেখ নেই। এছাড়া বিভিন্ন আসামির জবানবন্দিতে হাবিব, মাইনুল, কামাল ও শহীদ- এ চারজন ঘটনায় জড়িত বলে তথ্য এলেও তাদের নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়নি।
ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পেলে সম্পূরক অভিযোগপত্রের মাধ্যমে তাদের আসামি করা হবে বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
সারাবাংলা/আরডি/এমও