বিশেষ পদ্ধতিতে চাষ, বাজারে আম মিলবে আরও ২ মাস
২৯ আগস্ট ২০২৩ ১০:৩৭
নওগাঁ: নওগাঁয় দিন দিন বাড়ছে আম চাষের পরিধি। এ জেলায় সাধারণত জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আমের ভরা মৌসুম থাকে। এসময়ে একসঙ্গে অধিক পরিমাণে আম বাজারে আমদানি হওয়ায় চাষিরা আমের ভালো দাম পান না। তবে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে মৌসুমের আম মৌসুম শেষে ফলিয়ে লাভের মুখ দেখছেন নওগাঁর সাপাহার উপজেলার দোয়াশ গ্রামের রায়হান আলম (৪৫)।
বারোমাসি জাতের বাইরে বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও আম্রপালি জাতের আম চাষ করে এ সাফল্য পেয়েছেন রায়হান। স্বাভাবিকভাবে বারি-৪ ও ব্যানানা ম্যাঙ্গো জুলাই মাসেই শেষ হয়ে যায়। আর আম্রপলি আম তারও ১৫ দিন আগে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হয়। কিন্তু আগস্ট, সেপ্টেম্বর কিংবা তারপরেও বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও আম্রপলি পাওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারেননি। গাছের মুকুল বিলম্বিত করে মৌসুমের আম অমৌসুমে উৎপাদন করে অন্য চাষিদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন কৃষি উদ্যোক্তা রায়হান আলম।
পোরশা উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ছাওড় ইউনিয়নের বন্ধুপাড়া এলাকায় অবস্থিত রায়হান আলমের মিশ্র ফল বাগান। ওই বাগানে আম ছাড়াও ড্রাগন ও পেয়ারার গাছ রয়েছে। ওই বাগানের ১৫০টি বারি-৪, ৩০টি ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও ২০টি আম্রপালি গাছ থেকে অসময়ে আম পাওয়া যাচ্ছে।
এবার ভরা মৌসুমে প্রতি মণ বারি আম-৪ বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। অসময়ে রায়হানের বাগানে উৎপাদিত সেই আম এখন চার গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অসময়ে উৎপাদিত প্রতি মণ বারি আম-৪ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার টাকায়। ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও আম্রপালি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পরিপক্ক হবে।
পোরশার সারাইগাঁছী-আড্ডা সড়কের পাশে বন্ধুপাড়া মোড়সংলগ্ন ওই বাগানে গিয়ে দেখা যায়, গাছে গাছে ঝুলছে বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও আম্রপালি আম। কিছু গাছে ছোট ছোট আমের গুটি। আবার কিছু গাছে মুকুল এসেছে। অর্থাৎ বাগানটি থেকে অন্তত আরও তিন মাস আম পাওয়া যাবে।
রায়হান জানান, ২০১৯ সালে বন্ধুপাড়া এলাকায় ৫০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে সেখানে আম, পেয়ারা ও ড্রাগন ফলের বাগান গড়ে তোলেন তিনি। শুরুতে বাগানে নাবি জাতের গৌড়মতি আমের গাছ লাগান। তবে পরবর্তীতে গৌড়মতি জাতের কিছু গাছের ডাল কেটে ওই সব ডালে কলম করে বারি আম-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও আম্রপালি জাতে রূপান্তরিত করেন। মৌসুমের আম অমৌসুমে নেওয়ার জন্য চলতি বছর আম গাছে মুকুল আসার এক মাস আগে বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও আম্রপালি গাছের ডগা তিনি ভেঙে দেন। এরপর গাছের গোড়ায় রাসায়নিক ও জৈব সার ব্যবহার করেন। এছাড়া কৃষি বিভাগের পরামর্শে এক ধরনের হরমোন খুব সীমিত পরিমানে গাছে ব্যবহার করেন।
এতে ওই সব গাছে মার্চের পরিবর্তে মে মাসে মুকুল আসে। সেই মুকুলের আম এখন বড় হয়েছে। বারি-৪ গাছ থেকে গত সোমবার ৬ মণ আম ভেঙে বিক্রি করেছেন। প্রতি মণ আম ১২ হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। অথচ মৌসুমের সময় এই আমই বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়।
মুকুল আসা বিলম্বিত করে মৌসুমের আম অমৌসুমে উৎপাদন করলে ৪ থেকে পাঁচ গুণ বেশি লাভ হবে উল্লেখ করে রায়হান আলম বলেন, ‘বন্ধুপাড়া এলাকার এই বাগান ছাড়াও পোরশা ও সাপাহার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আমার আরও ১৫০ বিঘার আম বাগান আছে। মৌসুমের সময় যে আম ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছিলাম। সেই আমই এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকার ওপরে। মুকুল আসা বিলম্বিত করে ফলনেও কোনো ঘাটতি হয়নি। মুকুল আসা বিলম্বিত করে যেকোনো আম চাষিই চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি লাভ করতে পারবেন।’
এর আগে বারোমাসি বারি-১১ ও কার্টিমন জাতের আমে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে অসময়ে আম ফলানোর ঘটনা ঘটলেও নওগাঁতে বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও আম্রপালি আমে এ পদ্ধতি প্রথমবারের মতো ব্যবহার করে সফল হয়েছেন কৃষি উদ্যোক্তা রায়হান আলম। তার সফলতা দেখে অন্য আমচাষিরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
জাতীয় যুব পুরস্কার পাওয়া নওগাঁর সাপাহারের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে মুকুল কিংবা ডাল ভেঙে দিয়ে এবং এক ধরনের হরমোন ব্যবহার করে মুকুল আসা বিলম্বিত করা সম্ভব। এটা আমি নিজেও বিভিন্ন প্রশিক্ষণে গিয়ে শিখেছি। কিন্তু নিজে কখনও এই পদ্ধতি ব্যবহার করিনি। তবে রায়হান ভাইয়ের সফলতা দেখি আমিও সামনে বছর কিছু গাছে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মৌসুমের আম অমৌসুমে নিতে চাই। কাটিং পদ্ধতি ও সীমিত পরিমানে হরমোন ব্যবহার করে আমের মুকুল বিলম্বিত করার এই পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত।’
পোরশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘সিজনের সময় আম গাছে মুকুল এলে সেই সব মুকুল ও আমগাছের ডগা কেটে গেলে ওই সব গাছে ঠিক দুই মাস পরে আবারও মুকুল আসবে। এভাবে মুকুল ধরা বিলম্বিত করা বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও আম্রপালি আম অমৌসুমে উৎপাদন করা সম্ভব। তবে আমগাছ বেশি বয়সী না হলে আমরা চাষিদের হরমোন ব্যবহার করতে নিষেধ করি। কারণ এতে করে আমগাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
সারাবাংলা/এমও