এসিআই-লালতীরের কুমড়া বীজে কৃষকদের সর্বনাশ
২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:২১
চুয়াডাঙ্গা: ভরা মৌসুমে মিষ্টিকুমড়ার বীজ কিনে কোনো ফলন না পেয়ে বিনিয়োগ হারিয়ে দিশেহারা চুয়াডাঙ্গার চাষিরা। সরকার অনুমোদিত এসিআই ও লালতীর কোম্পানির কুমড়া বীজ কিনেছিলেন তারা। কিন্তু সেই বীজ কোনো ফলই দেয়নি। ক্ষতিগ্রস্তচাষিরা বীজ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছে বারবর ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। পরে তারা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বিভিন্ন সরকারি দফতরে।
এদিকে এ পরিস্থিতির জন্য বীজ কোম্পানির পাশাপাশি কৃষি কর্মকর্তাদেরও দোষ দেখছেন কৃষকরা। তারা বলছেন, বীজ থেকে ফলন না পাওয়ার বিষয়টি শুরু থেকেই কৃষি কর্মকর্তাদের তারা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। যখন গুরুত্ব দিয়েছেন, তখন আর কিছু করার ছিল না।
আখ চাষ হয় না— এমন পড়ে থাকা জমি বিঘা প্রতি ১০ হাজার ৫০০ টাকা দরে ছয় মাসের জন্য ইজারা দেয় চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনিকল। কয়েকজন চাষি জমিগুলো ইজারা নিয়ে মিষ্টিকুমড়া চাষ করেন। ভালো মানের বীজ বিবেচনায় তাদের অনেকেই এসিআই ও লালতীর কোম্পানির কুমড়া বীজ বপন করেন জমিতে। সেই বীজ থেকে বড় বড় গাছ হলেও তাতে কুমড়া ধরেনি। চুয়াডাঙ্গার হিজলগাড়ী, কোটালী ও ছয়ঘরিয়া গ্রামের চাষিদের প্রায় ১৭০ বিঘা জমিতে দেখা গেছে এমন চিত্র।
কৃষকদের দাবি, ফলন না আসায় কুমড়া আবাদ থেকে তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫১ লাখ টাকারও বেশি। জমি ইজারা, জমি প্রস্তুত করা, সার, কীটনাশক, বীজ, সেচ সব মিলিয়ে তাদের যে খরচ, তার এক পয়সাও তারা ফেরত পাবেন না। শুধু তাই নয়, ছয় মাস পূর্ণ হয়ে গেলেই এই জমি কোম্পানিকে ফিরিয়ে দিতে হবে বলে অন্য কোনো আবাদ দিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার সুযোগও তাদের সামনে নেই।
কোটালী গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত চাষি জুয়েল রানা আড়িয়া কৃষি খামারে ৩০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে লালতীর কোম্পানির বীজ কিনে কুমড়ার চাষ করেছিলেন। সেচ, কীটনাশকের প্রয়োগ করেছেন নিয়ম মেনে। সব মিলিয়ে তার খরচ হয় প্রায় ছয় লাখ টাকা। প্রত্যাশা ছিল, ভালো ফলন হলে বড় অঙ্কের লাভের মুখ দেখবেন। কিন্তু লাভ তো দূরের কথা, খরচের ছয় লাখ টাকার ধাক্কা কীভাবে সামলাবেন, তা নিয়েই গভীর দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
জুয়েল রানা বলেন, বীজ কেনার আগে তো কোম্পানির লোকজনই যোগাযোগ রাখত। সকাল-বিকাল ফোন দিত। এখন তারাই আর ফোন ধরে না। আমরা কৃষি বিভাগকেও বলেছিলাম। তারা বিষয়টি আমলেই নেয়নি। প্রায় তিন সপ্তাহ পর তারা ক্ষেত পরিদর্শনে আসে। ততদিনে আসলে আর কারও কিছু করার নেই।
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত চাষি হিজলগাড়ী গ্রামের সাইফুল আজম মিন্টু বলেন, আড়িয়া ও ডিহি কৃষি খামারের ৫০ বিঘা জমি ইজারা নিয়েছিলাম। লাগিয়েছিলাম এসিআই কোম্পানির কুমড়ার বীজ। দুঃখজনক হলেও সত্য, বীজ থেকে গাছ হলেও তাতে কুমড়া ধরেনি। বিষয়টি কোম্পানির প্রতিনিধি ও এলাকার দায়িত্বরত কৃষি কর্মকাতের বলেছি। কোনো কাজ হয়নি। প্রায় ১৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে বলে জানালেন তিনি।
ছয়ঘরিয়া গ্রামের চাষী শহিদুল ইসলাম শহিদ জানান, তিনি ৫০ বিঘা জমিতে লালতীর ও ১০ বিঘা জমিতে এসিআইয়ের কুমড়া বীজ বপন করেছিলেন। তারও কোনো গাছেই কুমড়া ধরেনি। বীজ বিক্রির সময় কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন তার তাদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ শহিদের। তার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ টাকা।
কোটালী গ্রামের আরেক চাষি আনিস উদ্দিন বলেন, ৩০ বিঘা কেরুর জমি ইজারা নিয়ে এসিআই ও লালতীর কোম্পানির কুমড়া বীজ বপন করেছিলাম। গাছে কোনো কুমড়াই ধরেনি। কোম্পানির প্রতিনিধিরা এখন আর দেখা করছে না।
ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের অভিযোগ করেন, কুমড়া বীজ বপনের পর গাছে ফল না আসায় কোম্পানি প্রতিনিধির পাশাপাশি তারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরিন বিনতে আজিজের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনেক দেরি করেন। কৃষকরা কোনো ধরনের সহায়তা চাইতে গেলে তিনি বিরক্ত হন বলেও অভিযোগ চাষিদের।
এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে ফসল উৎপাদনে কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটলে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বরাবর লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হয়। মিষ্টিকুমড়ার ফলন না হওয়া ইস্যুতে সেটিও করা হয়নি।
কুমড়ার বীজে ফলন না আসার বিষয়ে জানতে চাইলে এসিআই (বীজ) কোম্পানির এরিয়া সেলস ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন বলেন, বিষয়টি আমরা জানার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লালতীর কুমড়া বীজ কোম্পানির সেলস ম্যানেজার ফরিদ বলেন, চুয়াডাঙ্গা শহরের আলী হোসেন সুপার মার্কেটে অবস্থিত বগা মিয়ার দোকান থেকে বীজ নিয়ে আমি বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করি। ওই বীজ ভালা না মন্দ, সেটি আমার জানা নেই। এ বীজের দায়িত্ব নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, কয়েকজন চাষি এসিআই ও লালতীর কুমড়া বীজ বপন করে কুমড়ার ফলন পাননি। বিষয়টি জেনে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা চাষিদের জমিতে জৈব সার ব্যবহার করতে বলেন। তবে তা কোনো কাজে আসেনি। ফল না হওয়ার কারণ খুঁজতে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমা বলেন, এ জেলায় যে প্রতিষ্ঠানই বীজ বিক্রি করুক না কেন, তাদের ডেটাবেজ জেলা ও উপজেলা কৃষি কার্যালয়ে থাকা জরুরি। তাতে কোন কোন প্রতিষ্ঠান চাষিদের কাছে কী ধরনের ও কীসের বীজ বিক্রি করছে, তার তদারকি করা সহজ হয়। এ ঘটনায় চাষিদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। ফলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। আর বীজ বিক্রেতার কাছে একজন চাষি কিন্তু ক্রেতা। ফলে কৃষক বীজ নিয়ে প্রতারণার শিকার হলে তার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগও আছে।
সারাবাংলা/টিআর
এসিআই বীজ কেরু চিনিকল বীজে প্রতারণা মিষ্টিকুমড়া মিষ্টিকুমড়ার আবাদ মিষ্টিকুমড়ার বীজ লালতীর বীজ