Wednesday 13 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাঙ্গামাটির পাবলাখালী বনে বাঘসদৃশ কী দেখেছে স্থানীয়রা?

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:০৫

পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা। ছবি: সারাবাংলা

রাঙ্গামাটি: আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি। এই উপজেলার একটি ইউনিয়ন হলো ৩০ নম্বর সারোয়াতলী ইউনিয়ন। সারোয়াতলী ইউনিয়নের চিন্তারাম ছড়া নামের একটি পাহাড়ি এলাকায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের (বাঘ) উপস্থিতি দেখা গেছে বলে দাবি করছে স্থানীয়রা।

সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ওই এলাকার যৌথখামার গ্রামের বাসিন্দা বিদ্যাধন চাকমা’র একটি গরুকে আক্রমণ করে আহত করেছে বাঘসদৃশ ওই প্রাণীটি। সন্ধ্যা থেকে এই খবরটি স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে। যদিও বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন বন বিভাগ, তাদের সঙ্গে একমত বাঘ বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

বন কর্মকর্তা ও বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে পাহাড়ি এলাকায় বাঘ দেখার কথা বলা হচ্ছে সেখানে বাঘের অস্তিত্ব থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। যে প্রাণীটি পালিত গরুকে আক্রমণ করেছে সেটি বাঘসদৃশ অন্য কোনো প্রাণী হতে পারে। তবে কোনোভাবেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়।

৩০ নম্বর সারোয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তুষার কান্তি চাকমা গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি শোনার পর তিনি স্থানীয় কারবারির সঙ্গে কথা বলেছেন। কারবারি তাকে জানিয়েছেন, মাঝারি আকারের বাঘের মতো একটি প্রাণীকে জঙ্গলে দেখা গেছে। স্থানীয় এক ব্যক্তির একটি গরুকে প্রাণীটি জখম করেছে। ওই এলাকায় বনের আশপাশের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে আছেন।

বাঘাইছড়িতে বাঘ দেখার ‘উড়ো খবরে’ অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। এতে খুব অল্প সময়ে ‘বাঘ দেখা’র খবর ছড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে। বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা জুপিটার চাকমা বাপ্পী বলেন, ‘সোমবার দুপুরে বিদ্যাধন চাকমার একটি গরুকে আক্রমণের খবর পেয়েছি। এর আগেও সারোয়াতলী বনে (পাবলাখালী বনপ্রাণী অভয়ারণ্য) স্থানীয়রা বাঘের ডাক শুনেছে বলে জানিয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

বন বিভাগ বলছে, পাবলাখালীর এই অরণ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার থাকার সম্ভাবনা নেই। ছবি: সারাবাংলা

তবে যৌথখামার গ্রামের যে বাসিন্দার পালিত গরুকে আক্রমণের খবর পাওয়া গেছে, সেই বিদ্যাধন চাকমার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তিনি আদতে কী ধরনের প্রাণী দেখেছেন, সেটিও তাই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের অধীনেই রয়েছে কাচালং সংরক্ষিত বন। কাচালং সংরক্ষিত বনের একটি অংশ রয়েছে বাঘাইছড়ির উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নে। ‘পাবলাখালী বনপ্রাণী অভয়ারণ্য’ ও ‘পাবলাখালী গেম সেঞ্চুয়ারি রেঞ্জ’ নামের কাচালং সংরক্ষিত বনের এই অংশটির দায়িত্বে রয়েছে বন বিভাগের পাবলাখালী রেঞ্জ।

পাবলাখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা সজীব কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্থানীয়রা সারোয়ারতলী এলাকায় বাঘ দেখার কথা বললেও এটি সত্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থার (আইইউসিএন) যৌথ উদ্যোগে পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ছয় মাস আগেও ১৮টি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। কিন্তু ওই ক্যামেরা বিভিন্ন প্রাণীর গতিবিধি ধরা পড়লেও বাঘের কোনো অস্তিত্বে মেলেনি। যদি সত্যিই বাঘ থাকে তাহলে একটির ক্যামেরায় হলেও ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘ বছর পর বাঘ দেখার কথাটি বলা হলেও বাঘসদৃশ কিছু হতে পারে, যা দেখে মানুষ বাঘ বলছেন।’

সজীব মজুমদার আরও বলেন, ‘যদি বাঘ থেকেই থাকে সেক্ষেত্রে একটি বাঘ থাকবে না, একাধিক বাঘ থাকবে। নারী বাঘের পাশাপাশি পুরুষ বাঘ এবং একটি সার্কেলও থাকবে। আর এতগুলো বাঘ থাকলে বনের আশপাশের মানুষের সেগুলো অহরহ দেখা ও আক্রমণের শিকার হওয়ার কথা।’

জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাঘ মানে তো আমরা জানি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা। পাবলাখালীর বনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার সম্ভাবনা নেই। ডোরাকাটা বাঘের অস্তিত্ব এখানে নেই। স্থানীয় মানুষ যে প্রাণীটির কথা বলছেন সেটি চিতা বাঘ কিংবা মেছো বিড়ালও হতে পারে। আর গরুকে আক্রমণ করার কথা বলা হচ্ছে। আমরা আক্রমণের শিকার গরুটিকে দেখতে পারলে হয়তো তার ক্ষত দেখে বলা যেত হামলাকারী প্রাণীটি কী ছিল।’

পাবলাখালীর এই গভীর অরণ্যে বাঘ না থাকা নিয়ে বন বিভাগের দাবির সঙ্গে একমত বিশেষজ্ঞরাও। ছবি: সারাবাংলা

২০২১ সালে বন অধিদফতর ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থার (আইইউসিএন) সমন্বয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলার কাচালং সংরক্ষিত বনে বাঘের খোঁজে গিয়েছিল বাঘ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের একটি দল। ওই বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাঘ বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান। তিনি বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বাঘ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলায় বাঘের অস্তিত্ব আছে কি না— এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কাচালং সংরক্ষিত বন ও পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে গবেষণার জন্য গিয়েছিলাম। তবে সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ও গবেষণা করে দেখা গেছে কাচালং সংরক্ষিত বনে বাঘের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা থাকলেও পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বাঘ থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

এই বাঘ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, গবেষণা করে আমরা দেখেছি বাঘাইছড়ির সংরক্ষিত বনে চিতা বাঘ, মেছো বাঘসহ দুই প্রজাতির ভাল্লুক রয়েছে। মায়া ও সম্বর হরিণ নামের দুই প্রজাতির বুনো হরিণ রয়েছে। পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বাঘ দেখার কথা বলা হলেও সেটি চিতা বাঘ, মেছো বাঘা কিংবা অন্য কোনো প্রাণী হতে পারে বলে ধারণা করছেন এই বাঘ বিশেষজ্ঞ।

প্রসঙ্গত, এক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘের অস্তিত্ব ছিল বলে দাবি করে আসছেন স্থানীয়রা। বাঘের অস্তিত্ব থেকেই রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে বলেও একটি মিথ রয়েছে। তবে বিগত কয়েক দশকেও সরাসরি কেউ বাঘ দেখেনি বাঘাইছড়ির কোনো বনে। বাঘ বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির কাচালং সংরক্ষিত বনে এক সময়ে বাঘের বিচরণ ছিল বলে তারা নানা নমুনা পেয়েছেন।

সারাবাংলা/একে

পাবলাখালী বন বাঘের আতঙ্ক রাঙ্গামাটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর