পুতিন-কিম জং মৈত্রী কতটা ভয়ানক?
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:১০
এ মাসেই রাশিয়া সফরের কথা জানিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার একাধিপতি কিম জং উন। সফরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা রয়েছে। দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হতে পারে, সে বিষয়ে পিয়ংইয়ং বা মস্কো তেমন কোনো তথ্য দেয়নি। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করার বিষয়টিই হবে দুই নেতার প্রধান আলোচ্য বিষয়।
কিম জং উনের রাশিয়া সফর এবং সফরে কিম ও পুতিনের মধ্যে সম্ভাব্য বৈঠক এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোতে আলোচনার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে এই বৈঠক গভীর উদ্বেগও ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া যদি কোনোভাবে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কোনো ধরনের যৌথ পরিকল্পনায় পৌঁছায়, তা সারাবিশ্বের জন্যই হুমকির কারণ হয়ে দাাঁড়াবে বলে মনে করছে পশ্চিমা বিশ্ব।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্র বেচাকেনা নিয়ে কোনো চুক্তি হলে সেটি দুই দেশের জন্যই হবে চূড়ান্ত লাভজনক। ইউক্রেনের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধে জড়ানোর ফলে রাশিয়ার এখন প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ চাই। দেশটি রীতিমতো এরকম অস্ত্র-গোলাবারুদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে অস্ত্র-গোলাবারুদ দুটিই অঢেল রয়েছে উত্তর কোরিয়ার।
অনদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে জারি করা নিষেজ্ঞার আওতায় থাকা উত্তর কোরিয়ার প্রয়োজন অর্থ আর খাদ্য। তিন বছর হলো দেশটির সীমান্ত প্রায় বন্ধ। এর আগে ২০১৯ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কচ্ছেদ হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটি আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাদা চোখে দেখলেও রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র বেচাকেনার চুক্তি উত্তর কোরিয়ার জন্য বড় ধরনের স্বস্তি হয়ে আসবে।
আরেকটু গভীরভাবে দেখলে এই সম্ভাব্য চুক্তির মাধ্যমেই পিয়ংইয়ং ও মস্কোর আর ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগের দ্বার উন্মোচন হবে। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে অস্ত্রচুক্তির বিষয়ে সতর্ক করে আসছে। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উনের বৈঠক এই চুক্তিকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
এদিকে কিম-পুতিনের বৈঠকের খবরে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর উদ্বেগের বিষয়ে বৈচিত্র্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্পমেয়াদি অগ্রাধিকার নিশ্চিতভাবেই হবে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রশস্ত্র যেন ইউক্রেনের যুদ্ধে না আসতে পারে সেটি নিশ্চিত করা। কিন্তু অস্ত্রের বিনিময়ে কিম রাশিয়া থেকে কী পাবেন, সেটিই সিউল তথা দক্ষিণ কোরিয়ার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ সিউল মনে করছে, রাশিয়া অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠার কারলে কিম জং উন দেশটির কাছ থেকে অস্ত্রের দাম হিসেবে অনেক বেশি কিছু আদায় করে নেওয়ার পরিস্থিতিতে আছেন। এ ক্ষেত্রে কিম রাশিয়ার কাছ থেকে সামরিক সহায়তাও চাইতে পারেন বলে মনে করছে সিউল।
বিবিসির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সোমবার দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা ব্রিফ করেছে সাংবাদিকদের। তারা বলছে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগু এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া যৌথ নৌ মহড়া চালাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিা ও জাপান দীর্ঘদিন ধরেই এমন নৌ মহড়া দিয়ে আসছে। এ ছাড়া কিম ভবিষ্যতেও রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র নিতেই পারবেন।
তবে এসবের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের জায়গা হলো দুই দেশের মধ্যে আধুনিক অস্ত্র নির্মাণের কলাকৌশল বা জ্ঞান বা প্রযুক্তি বিনিময়ের সম্ভাবনা, যা হয়তো কিমের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে আরও বেগবান করবে এবং নতুন কিছু করার সুযোগ করে দেবে। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়া এখনো গোয়েন্দা স্যাটেলাইট ও পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন সাবমেরিনের মতো কৌশলগত অস্ত্রশস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি নিয়ে সংগ্রাম করছে।
দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তারা অবশ্য এখনই পুতিন-কিম বৈঠক থেকে কিমের জন্য এত বেশি প্রাপ্তি হতে পারে বলে বিশ্বাস করছেন না। তা না হলেও বিশ্লেষকরা পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেই মনে করছেন।
এশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিসের রিসার্চ ফেলো ইয়াং ইউক বলছেন, রাশিয়া যদি উত্তর কোরিয়ার কাছে এখন অস্ত্র বিক্রি নাও করে, তাহলেও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণায় রাশিয়ার অর্থ নিয়োজিত হতে পারে। ইয়াং বলেন, রাশিয়া যদি অস্ত্রের দাম তেল ও খাবার দিয়ে পরিশোধ করে, সেই তেল ও খাবার উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করায় ভূমিকা রাখবে, যা প্রকারান্তরে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র নিয়ে গবেষণাকেই শক্তিশালী করবে। এটি তাদের জন্য বাড়তি আয়ের একটি পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে সুযোগ আগে কখনো ছিল না।
সামরিক কৌশল ও অস্ত্র ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ ইয়াং আরও বলেন, ১৫ বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার জাল বিছানো হয়েছে এমনভাবে যেন তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মতো অস্ত্র তৈরি ও সেগুলোর ব্যবসা করতে না পারে। এখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া পুরো ব্যবস্থাটিকেই অকার্যকর করে দিতে পারেন।
উত্তর কোরিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যত বেশি প্রকট হয়েছে, দেশটি ততই চীনের ওপর আরও বেশি বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চীনও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধের উচ্চকণ্ঠ নয় কখনোই। এর মধ্যে গত বছর উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র পরীক্ষার জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে শাস্তির প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু বেইজিং সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। অর্থাৎ উত্তর কোরিয়া বড় ধরনের শাস্তির মুখোমুখি না হয়েই অস্ত্র তৈরি অব্যাহ রাখতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়াতে মার্কিন সৈন্য রয়েছে। উত্তর কোরিয়া এ ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের জন্য এক ধরনের বাফার হিসেবে কাজ করে থাকে। এর বিনিময়ে পিয়ংইয়ংকে মূল্য চুকাতে হয় বেইজিংকে। কিন্তু কেবল চীনের ওপর ভরসা করে থাকা নিয়ে পিয়ংইয়ং কখনোই স্বস্তিতে থাকেনি। এখন রাশিয়া সফর সামনে রেখে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে কিম জং উন তার নেটওয়ার্ক বাড়ানোর সুযোগ পাবেন।
এদিকে রাশিয়াও মরিয়া। ফলে কিম জং উন এমনটি ভাবতে পারেন- বেইজিংয়ের চেয়ে মস্কোর কাছ থেকে আরও বেশি কিছু আদায় করে নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে দেখা যাবে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালালেও এ নিয়ে টুঁ শব্দটি না করার বিষয়ে সম্মত হয়ে থাকতে পারেন পুতিন, যেটি আবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছে প্রত্যাশা করা যায় না।
সিংগাপুরে এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ড. বার্নার্ড লু বলেন, বাচ্চারা মা-বাবার সঙ্গে যেভাবে খেলা করে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়া ও চীনকে নিয়ে একই ধরনের কাজ করেছিল।
তবে পুতিন ও কিমের মধ্যে বৈঠকটি আদৌ হবে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। কিম জং উন সাধারণত উত্তর কোরিয়া থেকে বের হন না বললেই চলে। তিনি তার নিরাপত্তা নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে থাকেন। তার বিদেশযাত্রাকেও বিপদসংকুল বলেই বিবেচনা করেন। কিমের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সফর ছিল ২০১৯ সালে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে হ্যানয় গিয়েছিলেন তিনি। পরে এপ্রিলে ভ্লাদিভস্টক গিয়েছিলেন পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কিমের যাত্রা ছিল সশস্ত্র একটি ট্রেনে। এর মধ্যে কিম হ্যানয় গিয়েছিলেন চীন হয়ে দুই দিন ধরে যাত্রা করে।
কিম-পুতিন বৈঠকের আলোচ্যসূচি বা সিদ্ধান্ত কতটুকু প্রকাশ করবেন আর কতটুকু গোপন রাখবেন, সে বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা প্রত্যাশা করতে পারেন যে এই বিষয়গুলো জনসম্মুখে আসবে আর তার সূত্র ধরে তারা কিম জং উনের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হতে পারবেন। এর মধ্যে রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার মিলন থেকে শুরু করে সম্ভাব্য অস্ত্র চুক্তিও ব্যর্থ করে দেওয়া সম্ভব হবে। কিম জং অবশ্য খুব বেশি নড়াচড়ার সুযোগ পাবেন বলে মনে করছেন না ড. লু।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া বিভিন্ন কৌশলের একটি হলো গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশ, যেন আলোচনায় থাকা চুক্তিগুলো সই না হয়। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার কেউই এখন পর্যন্ত অস্ত্র বেচাকেনার কোনো ধরনের চুক্তির কথা বেমালুম অস্বীকার করেছে। এরকম কোনো চুক্তি হলে সেটি প্রকাশ করা হবে, এমন আশাও সম্ভবত দূরাশা।
সারাবাংলা/টিআর
অস্ত্রচুক্তি উত্তর কোরিয়া কিম জং উন পারমাণবিক অস্ত্র ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়া রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া