Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জি২০ সম্মেলন: অর্থনীতি ছাপিয়ে কূটনীতিতে বাজিমাতের চেষ্টা ভারতের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৫০

শক্তিশালী অর্থনীতির ২০টি দেশের সম্মিলন জি২০। বৈশ্বিক অর্থনীতির ৮৫ শতাংশ এবং বিশ্ববাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই দেশগুলোই। এসব দেশের জনসংখ্যা বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার সমান। এই জোটের সম্মেলন তাই বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে এবারে ভারতের নয়াদিল্লিতে যে জি২০ সম্মেলন হচ্ছে, সেটি অর্থনীতির চেয়ে অনেক বেশি কূটনৈতিক দিক থেকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন চিত্র আগে কখনো দেখা যায়নি।

বিজ্ঞাপন

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বরের এই জি২০ সম্মেলন ঘিরে গত এক বছর ধরেই প্রচার চালিয়ে আসছে ভারত সরকার। দিল্লির সড়কে সড়কে নরেন্দ্র মোদির ছবিসম্বলিত বিশাল বিশাল সব বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছে। এসব বিলবোর্ডে স্বাগত জানানো হয়েছে জি২০ সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিশ্বনেতাদের। অন্য শহরগুলোতেও জি২০ সম্মেলন নিয়ে রয়েছে নানা প্রচারণা। বৈশ্বিক একটি প্ল্যাটফর্মের সম্মেলনের বার্তা ভারত সরকার সারাদেশেই ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

বিজ্ঞাপন

জি২০ সম্মেলন যখন হচ্ছে, তখনো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে এবং এর প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। কিন্তু এই যুদ্ধ থামানো বা রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আনার বিষয়টি পুরোটাই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক। তারপরও জি২০ সম্মেলনে ভারত একটি যৌথ ঘোষণায় জোটভুক্ত দেশগুলোকে সম্মত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোনো নির্দেশনা থাকবে। এর বাইরেও আরও বড় কিছু বৈশ্বিক ইস্যু আছে, যেগুলোতে জি২০ সম্মেলন থেকে যৌথ ঘোষণা আনার চেষ্টা করবে ভারত। কিন্তু বৈশ্বিক এস্ ইস্যুতে নিজ নিজ স্বার্থ বিবেচনায় জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে সবচেয়ে বড় ইস্যু বলা যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা। গত বছর জি২০ সম্মেলন হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানেও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল আলোচনার অন্যতম বিষয়। কিন্তু সেবারেও জোটভুক্ত দেশগুলো সর্বসম্মত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। যৌথ ঘোষণাতেও বলা হয়, এই বিষয়টিতে তাদের নিজেদের মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে।

গত বছরের তুলনায় এ বছর এসব দেশের নিজ নিজ অবস্থান আরও কঠোর হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে। এই যুদ্ধ নিয়ে অন্যদের অবস্থান যাই হোক, রাশিয়া-চীন কোনোভাবেই এই যুদ্ধে রাশিয়ার দায় স্বীকারের পক্ষে কোনো অবস্থান নেবে না। অন্যদিকে সর্বসম্মতভাবে এই যুদ্ধের নিন্দা না জানালে সেই ঘোষণা পশ্চিমাবিশ্বেও গৃহীত হবে না। তাছাড়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই সম্মেলনে অংশও নিচ্ছেন না। চীনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী লি কুইয়াং আর রাশিয়ার পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ অংশ নিচ্ছেন জি২০ সম্মেলনে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বাইরে এই দুজন প্রতিনিধি বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ফলে এই যুদ্ধ নিয়ে বড় ধরনের কোনো যৌথ ঘোষণার সিদ্ধান্ত জি২০ জোটভুক্ত বাকি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য নেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য ২০ দেশের এই জোটকে অন্য দেশগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে ভারতের অবস্থান হলো— বিশ্ববাণিজ্যের ৭৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রা হিসেবে জোটের বাইরের দেশগুলো, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি জি২০ জোটের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। ‘গ্লোবাল সাউথ’ ডাকা হচ্ছে এই দেশগুলোকে। জি২০ সামিটে আফ্রিকান ইউনিয়নের উপস্থিতি এরই মধ্যে ভারতের এই অবস্থানকে জোরালো করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তানভী মদন বলেন, ঋণ কিংবা খাদ্য ও জ্বালানির দামবৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো যুদ্ধ এবং মহামারির কারণে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ভারতসহ জি২০তে অন্য যেসব উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে, তারা এই সংকটের সমাধানে শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রত্যক্ষ আর্থিক অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করছে।

এ বিষয়ে কোনো মতৈক্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ভারত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বলে আসছে, যেসব দেশ ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে, উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত সেসব দেশকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। কিন্তু চীনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর ঋণের বাৎসরিক কিস্তির পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ডিসেম্বরের এ পরিসংখ্যান জানিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস জানিয়েছিলেন, এই ঋণের দুই-তৃতীয়াংশেরই জোগানদাতা চীন। এই ঋণের বোঝা টানতে গিয়ে অনেক দেশ ঋণখেলাপি হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া ঋণের চাপে বাড়তে পারে দারিদ্র্য, আচমকা উল্লম্ফন ঘটতে পারে খাদ্য ও জ্বালানির দামে।

তানভী মদন বলেন, ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর জন্য এখন ঋণদাতা দেশগুলোর সহায়তা প্রয়োজন। তাদের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা পুনর্নির্ধারণ করে তারা দেশগুলোকে সহায়তা করতে পারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও অর্থায়নের মাধ্যমে সেই সহায়তা করা যেতে পারে। আমরা এখনো জানি না, জি২০ থেকে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আসবে কি না। কিন্তু এই আলোচনার মূল জায়গাটি হলো, দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের আপস হতে হবে।

এর আগে অবশ্য ২০২০ সালে জি২০ দেশগুলো ঋণ পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি ‘কমন ফ্রেমওয়ার্কে’ সম্মত হয়েছিল। তবে সেই প্রক্রিয়ার গতি অত্যন্ত ধীর। এ ক্ষেত্রেও পশ্চিমা দেশগুলো চীনকেই দোষ দিয়ে আসছে, যা আবার চীন অস্বীকার করে আসছে। বর্তমানে ভারতের চাওয়া, সেই কমন ফ্রেমওয়ার্ক মধ্য আয়ের দেশসহ অন্য দেশগুলোর মধ্যে বিস্তৃত করা হোক, যার জন্য ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি জানিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেয়ে ঋণসংকটে চীনের দোষ ধরতে বেশি ব্যস্ত থাকলে পুরো বিষয়টাই কেঁচে যাবে।

ভারতের আলোচ্যসূচিতে আরও রয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সির একটি বৈশ্বিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ও এ পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করা। নরেন্দ্র মোদি সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারও এক নিবন্ধে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন। তবে এখানে একটি সংকটও রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ভারত বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখাচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নশীল অনেক দেশই এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনায় সম্মত নয়। কেননা এই পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হবে, প্রকারান্তরে কমাতে হবে শিল্পায়ন, যা দেশগুলো প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হতে পারে। এসব দেশ বরং জলবায়ুসংকটের জন্য শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোকে দায়ী করে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ওইসব দেশের কাছ থেকে অর্থ, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত ‍সুবিধা নিতেই বেশি আগ্রহী।

এমন পরিস্থিতিতে জি২০ সম্মেলন থেকে জলবায়ু ইস্যুতেও বড় কোনো অগ্রগতি দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব বিবিসিকে বলেন, বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আসুক বা না আসুক, দিল্লিতে জি২০ সম্মেলনে ভারত জলবায়ু ইস্যুতে ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে আরও বেশি প্রতিশ্রুতি আদায়ের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাবে। ভারতের জন্য এটি এই সম্মেলনের বড় একটি এজেন্ডা।

জি২০ সম্মেলনে আলোচ্যসূচিতে গুরুত্ব পাবে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টিও। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ইস্যুতে সর্বসম্মত কিছু ঘোষণা আসতে পারে। ইউক্রেনের শস্য আন্তর্জাতিক বাজারে ফের ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত মস্কো-কিয়েভ যৌথ সম্মতি। সেটি সম্ভব না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায় বিকল্প আর কী কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে ভারত। এর বাইরে সম্মেলন থেকে কৃষি, মহামারি প্রতিরোধ প্রস্তুতি, স্বাস্থ্যসেবা ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে সেসব সিদ্ধান্ত যৌথ ঘোষণায় আসবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

শেষ পর্যন্ত জি২০ সম্মেলন থেকে বড় ইস্যুগুলোতে যৌথ ঘোষণা না-ও আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ চীন এখন ব্রিকস, সাংহাই কোঅপারেশন অরগানাইজেশনের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে বেশি মনোযোগী। পাঁচ দেশের ব্রিকসের সর্বশেষ সম্মেলনে আরও ছয়টি দেশকে যুক্ত করা হয়েছে, যাদের কেউ কেউ জি২০ জোটেও আছে এবং তাদের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও ভালো।

অন্যদিকে ভারত জি২০, ব্রিকস ও সাংহাই কোঅপারেশন অরগানাইজেশন ছাড়াও পশ্চিমাবিশ্ব নিয়ন্ত্রিত কোয়াড, জি৭-এর মতো জোটেরও সদস্য। আবার সীমানা নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব সম্প্রতি আরও প্রকট হয়েছে। ফলে জি২০ সম্মেলনে ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক ইস্যুতেই চীন আগ্রহ নাও দেখাতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে ফলে জি২০ সম্মেলন থেকে বড় ইস্যুতে যৌথ ঘোষণা না এলে স্বাগতিক দেশ হিসেবে ভারতকে ব্যর্থ হিসেবে ঘোষণা করতে রাজি নন বিশেষজ্ঞরা। বরং এই সম্মেলনের মাধমে মানবাধিকারসহ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে চাপের মুখে থাকলেও নরেন্দ্র মোদি বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেকে বিশ্বনেতা হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ পাবেন। সেটি দেশেও তার ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে, যা সামনের বছরের নির্বাচনের জন্য তার জন্য বড় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

জি২০ সম্মেলনের বার্তা রাজধানী নয়াদিল্লি কেবল নয়, ছোট ছোট শহরেও পৌঁছে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন নরেন্দ্র মোদি। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতা— এ ক্ষেত্রে দুটিই ছিল তার বিবেচনায়। সম্মেলনটি ব্যাপকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হলে বড় সাফল্য না এলেও সেটি মোদির পক্ষেই যাবে, যা জি২০’র মতো অর্থনৈতিক জোট থেকেও মোদির কূটনৈতিক সাফল্যের পরিচয়ই বহন করবে।

আরও পড়ুন:

সারাবাংলা/টিআর

খাদ্য নিরাপত্তা জি২০ জি২০ সম্মেলন জ্বালানি নিরাপত্তা বৈশ্বিক অর্থনীতি. নরেন্দ্র মোদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর