হিমাগারে আলু সিন্ডিকেট: কেজি প্রতি মুনাফা ১৬ টাকা!
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:০৭
ঢাকা: আদা, রসুন, পেয়াঁজের পর এবার সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আলু। বর্তমানে প্রতি কেজি আলু পাইকারি বাজারে ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে তা আরও বেড়ে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও হিমাগারে সংরক্ষিত প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন, পরিবহন ও ভাড়াসহ খরচ পড়ছে মাত্র ১৮ থেকে ২০ টাকা। কিন্তু হিমাগারে আলু সংরক্ষণকারী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে প্রতি কেজি আলু বিক্রি করছে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকায়। এতে আলু সংরক্ষণ করা ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজিতে মুনাফা করছে ১৬ টাকা। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। বিভিন্ন পাইকারি, খুচরা, কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে আলোর কোনো সংকট নেই। চাহিদার চেয়ে বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে বেশি পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করা আছে। যা দিয়ে আগামী ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পর্যন্ত অনায়াসে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাজারে নতুন আলু আসা শুরু করবে। তখন কোল্ড স্টোরেজের আলুর আর কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। তা সত্ত্বেও এক শ্রেণির মজুদদার সিন্ডিকেট করে আলুর দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে কোটি কোটি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে এই ধরনের সিন্ডিকেট ভাঙা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। তাদের অভিযোগ কারা সিন্ডিকেট করে আলু দাম বাড়িয়েছে, কাদের কাছে কী পরিমাণ আলু সংরক্ষিত রয়েছে। তা আমরা জানি, সরকার চাইলে আমরা সহায়তা করব।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমরা কাজ করছি। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, আলুর বাজার সিন্ডিকেটকারীদের ধরতে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে, সরকার চাইলে এ ব্যাপারে সহায়তা করা হবে।
এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। কেউ সিন্ডিকেট করে মূল্য বৃদ্ধি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সরকার যে কারও সহায়তা নিতে প্রস্তুত।’
আলুর উৎপাদন
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ১ কোটি ১২ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। দেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসেবে ২২ লাখ মেট্রিক টন আলু অতিনিক্ত উৎপাদন হয়েছে। ফলে দেশে আলুর সংকটের কোনো সুযোগ নেই।
হিমাগারে আলুর মজুদ
চলতি বছরে দেশে প্রায় চার শতাধিক হিমাগারে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন আলু সংরক্ষিত আছে। তবে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী এর পরিমাণ ২৪ লাখ ৯২ হাজার ৮২ মেট্রিক টন। চলতি বছরের ২০ মে তারিখের পর থেকে হিমাগার থেকে আলু বের হওয়া শুরু হয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১০ লাখ মেট্রিক টন আলেু বের হয়েছে। এখনও দেশের হিমাগারগুলোতে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন আলুর মজুদ রয়েছে। এই আলু দিয়ে আগামী ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অনায়াসে চালানো যাবে। ডিসেম্বরের শুরুতে বাজারে নতুন আলু আসা শুরু হবে। ফলে দেশে আলুর কোনো সংকট নেই।
হিমাগারে অতিরিক্ত দামে আলু বিক্রি
চলতি ২০২৩ সালে কেজি প্রতি আলুর উৎপাদন খরচ (সার কীটনাশক, মজুরি ও পরিবহনসহ) ১২ থেকে ১৩ টাকা। এর সঙ্গে হিমাগার ভাড়া প্রতি কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা। ফলে প্রতি কেজি আলুর হিমাগার শেডে সর্বোচ্চ মুল্য দাঁড়ায় ১৮ থেকে ২০ থেকে। ফলে হিমাগারে সংরক্ষিত প্রতি কেজি আলু ২২ থেকে ২৩ টাকা বিক্রি করলেই ব্যবসায়ীদের লাভ থাকে। কিন্তু চলতি সেপ্টেম্বর মাসে আলু সংরক্ষণকারী ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে প্রতি কেজি আলু বিক্রি করছে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা। এতে করে কেজিতে লাভ করছে ১৬ টাকা। অথচ গত মে মাসে যখন হিমাগার থেকে প্রথম আলো বের করা হয় তখন কেজি প্রতি আলু বিক্রি হয়েছে ২৬ থেকে ২৭ টাকা। কোনো কারণ ছাড়াই আলুর কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে গত তি মাসের ব্যবধানে হিমাগারেই আলুর দাম বেড়েছে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু সারাবাংলাকে বলেছেন, ‘মুনাফালোভী একটি চক্র আলু মজুদ করে দাম বৃদ্ধি করছে। এখানে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কোনো দায় নেই। কারা সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়াচ্ছে সরকার চাইলে সে সব তথ্য আমরা দেব।’
তিনি বলেন, ‘কোল্ড স্টোরেজ শেড থেকে যদি ২০ থেকে ২২ টাকায় আলু বের হতো তাহলে পরিবহন, আড়ত ও খুচরা বিক্রেতাদের খরচসহ সব মিলিয়ে এ আলু ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা মনে করি, মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে যারা আলু সংরক্ষণ করেছে তারা মনে করছে আলুর মজুত কম রয়েছে। এ জন্য তারা আলুর দাম বাড়াচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হিমাগারেই আলু সংরক্ষকারী ব্যবসায়ীরা বেশি দামে আলু বিক্রি করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। মূলত আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে করতে হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আগে হিমাগারে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ব্যাপারে চাইলে আমরা মহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছি।’
অন্যদিকে মতিঝিলে আলুর পাইকারি বিক্রেতা ও জলিল টেডার্সের মালিক আবদুল জলির সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) আলু বিক্রি করছি ২৫০ টাকা। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘কারওয়ান বাজার থেকে প্রতি কেজি আলু কেনা পড়ে ৪৪ টাকা। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ রয়েছে, পাশাপাশি কিচু আলু নষ্টও হয়ে যায়। ফলে ৪৬ টাকা কেজি পড়ে যায়। ৫০ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব না।’
অন্যদিকে খিলগাঁও বাজারে খুচরা বিক্রেতা মনির হোসেন প্রতিকেজি আলু বিক্রি করছে ৫৫ টাকা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক বস্তা (৫০ কেজি) আলু কিনি ২২০০ টাকায়, প্রতি কেজির দাম পড়ে ৪৪ টাকা। কেজিতে দাম পড়ে ৪৪ টাকা। কিছু আলু নষ্টও পড়ে। ফলে ৫৫ টাকার নিচে বিক্রি করলেও পোষায় না।’
সারাবাংলা/জিএস/একে