Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সেলফি কূটনীতি’তে বিএনপির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

তাপস হালদার
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৯:৪৪

জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ সদস্য না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘অতিথি রাষ্ট্র’ হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সরাসরি এটাই ছিল সর্বশেষ বৈঠক। সঙ্গত কারণেই এই সফর ঘিরে মানুষের মাঝে ব্যাপক কৌতুহল ছিল।আগামী নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশের মোড়লপনার কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভূমিকা কী হবে সেটি নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিল। নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ও ক্ষমতা পরিবর্তনের হাতিয়ার এদেশের জনগণ হলেও পশ্চিমা চাপ মোকাবিলার জন্য ভারতের একটি স্পষ্ট বার্তার দরকার ছিল।তবে এবারের সফরে বার্তাটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর শুরুই হয়েছে এক প্রকার রাজকীয় অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর বাসভবনেই শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকের আয়োজন করেন।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারতে গিয়ে সেদিন বিকেলেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে বৈঠকে মিলিত হন। প্রধানমন্ত্রী মোদি বাড়ির দরজায় এসে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে বাসভবনে নিয়ে যান। ঘণ্টাব্যাপী দুই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে একান্তে ১৫ মিনিট কথা বলেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। দুই প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিই প্রমান করে বৈঠকের গুরুত্ব। ভারতের পক্ষে প্রতিনিধি দলে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন প্রমুখ।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানের পর নরেন্দ্র মোদি টুইটারে আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলায় লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত নয় বছর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবেই সন্তোষজনক। আমাদের আলোচনায় বানিজ্যিক সংযোগ, সার্বিক সংযুক্তি এবং আরো অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকের পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠক করেন নরেন্দ্র মোদি। এ থেকেই বোঝা যায় হাসিনা-মোদি বৈঠকের গুরুত্ব।

দুই প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক আলোচনায় তিনটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হয়েছে। (এক) কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ কাউন্সিল ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচার রিসার্চের মধ্যে সমঝোতা। (দুই) শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক খাতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদারকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ। (তিন) পারস্পরিক লেনদেন সহজকরণের লক্ষ্যে ভারতের এনপিসিআই ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্টস লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা। এ ছাড়াও দুই নেতা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও সংযোগ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। আগরতলা -আখাউড়া রেল সংযোগ,মৈত্রী পাওয়ার প্লান্টের ইউনিট-২, খুলনা-মোংলা রেল সংযোগ প্রকল্প সুবিধাজনক সময়ে উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া মোদি মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত দশ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও বাংলাদেশ কর্তৃক ইন্দো প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতকরণের অনুরোধ জানান। রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা চেয়েছেন। উভয় প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি অর্থাৎ রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে চলমান কার্যক্রম বেগবান করতে ঐক্যমত হন।এগুলো সবই ছিল আনুষ্ঠানিক আলোচনা,তবে একান্ত বৈঠকে অবশ্যই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলেচনা হয়েছে।যার প্রতিফলন সফরের পরবর্তী সময় গুলোতে দেখা গেছে।

জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ অতিথি রাষ্ট্র হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ দুইটি সেশনেই বক্তব্য দিয়েছেন। এ ছাড়াও প্রতিটি কর্মসূচিতেই সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিডারস সামিটে চারটি প্রস্তাব তুলে ধরে বলেছেন, বিশ্বের সব মানুষেরই উপযুক্ত জীবনযাপনের অধিকার থাকা উচিত। এ জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাস্তবতা হলো মানুষ এবং আমাদের পৃথিবী কেবল পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমেই থাকতে পারে। এ ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ঐতিহাসিক শহর নয়াদিল্লিতে জি-২০ লিডারস সামিটে উপস্থিত হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বাংলাদেশকে অতিথি দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এ আমন্ত্রণ আমাদের দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের সম্পর্কের গভীরতা ও উষ্ণতাতে প্রতিফলিত করে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাইড লাইনে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ন সুক ইয়ল,আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ও সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সাথে। মধ্য প্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সাইড লাইনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দুই নেতা একসাথে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে ‘হাসিনা-বাইডেন’ সেলফি।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মূলধারার প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিটি গণমাধ্যমে বিষয়টি শিরোনাম হয়েছে। যদিও সেলফিটি নেহাতি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটি অনির্ধারিত একটি বৈঠকও বলা যেতে পারে। দুই রাষ্ট্রনায়কের ১৫ মিনিটের আলোচনায় দ্বিপাক্ষিক বিষয় ছাড়াও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় আলোচনায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাথে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেছেন জো বাইডেন এবং তাঁর কাজের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যোগাযোগের জন্য ভিজিটিং কার্ড চেয়ে নেন। একসঙ্গে ছবি তোলেন,সেখানে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকেই সেলফি তোলতে দেখা যায়। পুরোটা সময়ই তিনি আনন্দঘন পরিবেশে ছিলেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ সব বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন,আমি মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বলি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আপনার সাথে কথা বলতে চান। উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই।এভাবেই আলোচনার সূত্রপাত। কথোপকথনের সময় পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আবদুল মোমেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতি অনির্ধারিত আলোচনাটি আরও গুরুত্ববহ করে তুলেছে।

শুধু এখানেই শেষ নয়, ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রোপতি মুর্মুর আয়োজনে নৈশভোজে শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদি ও জো বাইডেন এই তিন রাষ্ট্রনায়ক একসঙ্গে আলোচনা করেছেন। সাধারণত দুইজন রাষ্ট্র প্রধান কথা বলার সময় অন্য কোনো রাষ্ট্রপ্রধান সেখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু আলোচনায় নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।এসময় পাশে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জো বাইডেনের প্রতিটি সাক্ষাৎ ছিল উষ্ণ ও আন্তরিকপূর্ণ। নেতাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজই বলে দেয় সম্পর্কের গভীরতা কতখানি। জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে যেভাবে দৃঢ়ভাবে করমর্দন করতে দেখা গেছে, সেখানে উষ্ণ সম্পর্কেই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাথে যেভাবে কথা বলেছে সেটা আন্তরিকপূর্ণ মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। নিন্দুকেরা যা বলুক না কেন,এটি শুধুমাত্র একটি সেফফি কিংবা ফটোসেশান নয়। এটি ছিল অনির্ধারিত একটি আলোচনা। যার প্রতিফলনও পরবর্তীতে দেখা যাবে।

জো বাইডেনের সেলফি তোলা নিয়ে ভারতের প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি গৌতম লাহিড়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করে বলেছেন,‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা শরীরি ভাষা, করমর্দন, কে কোথায় বসলো এগুলোর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এখন সেলফি ডিপ্লোম্যাসি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কোনো সাধারণ আলোক চিত্র শিল্পী ছবি তুলেছেন তাই নয়; বাইডেন আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্ট তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভয় পেয়ে সেলফি তবে,ব্যাপারটা তাও নয়। আমি কার সঙ্গে ছবি তুলি? যাকে আমি পছন্দ করি; যে আমার বন্ধু। ছবি একটা ফ্যাক্টর। আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সব মিটে গেছে এটা আমি বলবো না, তবে এটা সূত্রপাত হয়েছে। চীনের কারণে আমেরিকার প্রয়োজন ভারতকে। আবার ভারতের নিজস্ব স্বার্থে প্রয়োজন বাংলাদেশকে। সেজন্যই হয়তো ভারত সম্ভবত চাচ্ছে আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হোক; ভারত হয়তো সেই সূত্রধরের কাজটা করছে।যে যাই বলুক আমার কাছে এই সেলফি তোলার ব্যাপারটা বাংলাদেশের রাজনীতিকে গেম চেঞ্জার বলে মনে হয়।’ তিনি যথার্থই বলেছেন, এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অবশ্যই গেম চেঞ্জার হবে।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, ড.ইউনুস ইস্যুতে বিএনপি সহ বিরোধী মতাদর্শীরা আনন্দ উল্লাস শুরু করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিবাস্বপ্ন দেখেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে জো বাইডেনসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবিগুলো দেখে বিএনপি নেতাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার দিবাস্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
ইমেইল: haldertapas80@gmail.

জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর