সংসদ নির্বাচনে ইসির বড় চ্যালেঞ্জ মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:৩৬
ঢাকা: সবকিছু ঠিকটাক থাকলে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই হিসাবে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা। সাধারণত তফসিল থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে ৪৫ থেকে ৫৫ দিন হাতে রাখা হয়। ইতোমধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারপরেও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিদলগুলোর কাছে এখনও আস্থা অর্জন করতে পারছে না ইসি।
বিএনপি ও তাদের মিত্রদের আস্থা অর্জনের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা। সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কতটা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে, ইসির নির্দেশনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করবে কি না- সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে ইসির সমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ।
সম্প্রতি (১৩ সেপ্টেম্বর) নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক বৈঠকে অংশ নিয়ে বেশির ভাগ বক্তা ইসির ভূমিকার সমালোচনা করেন। তাদের মতে, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ডিসি, এসপি, ওসি তথা স্থানীয় প্রশাসনকে নির্বাচন কমিশন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। যার বড় উদাহরণ হলো- স্বয়ং নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ইসি’র সঙ্গে ডিসি-এসপিদের অসৌজন্যমূলক আচরণ। যদিও ওই ঘটনার পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির সঙ্গে ১৩৩ কর্মকর্তা জড়িত থাকার বিষয়টি ইসির তদন্তে উঠে এলেও এখনও কারও বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো শাস্তি নেওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে একজন প্রার্থীর ওপর হামলা হলেও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ রেখে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা বর্তমান কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।
এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০১৩ সালে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। আর ২০১৮ সালের নির্বাচেনে সব বিরোধীদল ও জোট নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটার ও প্রার্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ ছিল না। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগেই ভোট হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলেন, আগের রাতেই ভোট হয়ে গেছে। ফলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক দলীয়করণের অভিযোগ ওঠে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন তাদের হাতে ক্ষমতা থাকার পরও গাইবান্ধা নির্বাচনে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।’
অন্যদিকে, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ডিসি-এসপি’দের নিরপেক্ষ ভূমিকা অতি জরুরি। তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা হবে আগামী নির্বাচনে ইসির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে একজন প্রার্থীকে মারধর করা হলো। এটা কিভাবে হলো? এখন দেখা যায়, পলিটিক্যাল পার্টি সেন্টার পাহারা দেয়। সেন্টারে কারা পাহারা দেয়- এদের শনাক্ত করে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, এদের কারণে ভোটারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন না। এই ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
অন্যদিকে, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনে যার যে কাজ তাকে সেটাই করতে হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তার কাজটা ঠিকমতো করতে পারছে না। কারণ সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারী নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবেন। কিন্তু সহায়তা না করলে কী হবে সেটা বলা নাই।’
তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে সবাইকে যার যার দাযিত্ব পালন করতে হবে। একজন ওসি যখন ভোট চায়, কিংবা একজন ডিসি যখন নির্দিষ্ট কোনো দলের জন্য ভোট চায়, তখন পুলিশের আইজিপি, জনপ্রশাসন সচিব ও মন্ত্রী কেন কোনো পদক্ষেপ নেন না? আমরা বারবার বলেছিলাম, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা সরকারি কর্মকর্কতারা না মানলে কী হবে এ বিষয়ে প্রযোজনীয় আইন করতে হবে। কিন্তু করা হয়নি।’
ডিসি-এসপিদের আচরণে বিব্রত ইসি, নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা
গত বছরের ৮ অক্টোবর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে আস্থাহীনতার জন্য ডিসি-এসপিদের দায়ী করে জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় এমপিদের তরফে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কথাও তুলে ধরছিলেন। এ সময় ইসি কমিশনার ডিসিদের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নখ-দন্তহীন এবং তারা মন্ত্রী-এমপিদের ছাড়া চলতে পারেন।’ তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে সভাকক্ষেই ডিসি-এসপিরা হইচই শুরু করে। এ সময় সিইসিসহ অন্য কমিশনার ও জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবও মঞ্চে ছিলেন। এক পর্যায়ে কমিশনার আনিসুর রহমান বলেন, ‘তাহলে কি আপনারা আমার বক্তব্য শুনতে চান না?’ তখন সবাই একযোগে ‘না’ বললে নিজের বক্তব্য শেষ না করেই বসে পড়েন ইসি আনিসুর।
এ বিষয়ে সিইসিসহ পুরো কমিশন কোনো মন্তব্য না করায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের আচরণে বিব্রত হয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বেশ কয়েকদিন অফিস করেননি। তিনি পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন— এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও এক সপ্তাহ পরে তিনি ফের অফিসে ফেরেন। ইসি কমিশনারের প্রতি নিয়মবহির্ভূত ও নজিরবিহীন এমন ঘটনার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার গাজী শাহওনেয়াজ ওই সময় সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কয়েকজন ডিসি-এসপি যে আচরণ তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা শিষ্টাচারবর্হিভূত। এদের শাস্তির আওতায় আনার প্রয়োজন ছিল।’
গাইবান্ধা উপনির্বাচনে অনিয়মে জড়িতদের শাস্তি হয়নি
২০২২ সালের ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসনের সামনেই ব্যাপক অনিয়ম ও ভোট কারচুপি হয়। যা সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করে ইসি। এক পর্যায়ে পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেয় ইসি। এর পর নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ইসির তদন্ত কমিটি ৬৮৫ জনের শুনানি করে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পায়। ইসির তদন্তের আলোকে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়মে জড়িত থাকার সুনিদিষ্ট অভিযোগে ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তির নির্দেশ দিয়েছিল (ইসি)। কিন্তু ইসি‘র সেই নির্দেশের প্রায় ১০ মাস পার হলেও এখনও কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বড়ধরনের কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বরং নির্বাচনে রিটানিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকারী অভিযুক্ত ইসি কর্মকর্তাকে আরও ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বয়ং নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষকের ইনক্রিমেন্ট এক বছরের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। বিপরীতে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী ইসি কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের পাঁচজন উপ-পরিদর্শক, একজন সহকারী উপপরিদর্শকসহ এসব কর্মকর্তাদের শাস্তির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ শনিবার সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাইবান্ধা উপনির্বাচনে অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৩৩ জনকে চিঠি দেওয়া হলেও ৪০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হয়েছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন।’ এই ৪০ জন কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এদের বেশিরভাগ শিক্ষক। এদের বিরুদ্ধে গত ১৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শুনানিও হয়েছে।’
অন্যদিকে, স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জনপ্রশাসনে শুনানি চলছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থীর ওপর হামলা
গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলা করা হয়। এই হামলার ঘটনায় পুলিশের অবহেলার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন দূতাবাস বিবৃতিও দেয়। সেইসঙ্গে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ তুলে দায়িত্বরত পুলিশের ভূমিকা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেন। সেই চিঠি দেওয়ার প্রায় দুই মাস পার হলেও কোনো পুলিশ সদস্যর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে হামলাকারী কয়েকজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ শনিবার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কমিশনার বরাবর নির্বাচন কমিশন থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা এখনো আমাদের জানানো হয়নি।’
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম