Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পরিবার-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবহেলায় আত্মহত্যার মিছিল

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:১৪

ঢাকা: পছন্দের কলেজে ভর্তি নিয়ে বাবার সঙ্গে মনোমালিন্য। এর জের ধরে গত ৯ সেপ্টেম্বর নিজের ঘরে গলায় ফাঁস দেয় বাড্ডার মীম (১৭)।

এর কয়েকদিন আগে ২১ আগস্ট নিজের ঘরে গলায় ওড়না পেচিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় রাজধানীর ঠাটারীবাজারের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী স্নেহা আদ-দীন মেঘাকে (১৫)। স্বজনরা জানান, সে মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল।

একই দিন বিকেল ৫টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নিজ কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয় ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল ইসলামের ঝুলন্ত মরদেহ।

এর আগে চলতি বছরের মে মাসে তিন দিনের ব্যবধানে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) দুই শিক্ষার্থী। ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় হলের নিজ কক্ষে আত্মহত্যা করেন মেকানিক্যাল বিভাগের ১৮ সিরিজের চতুর্থ বর্ষের তানভীর ফাহাদ রুমি। ২০ মে রাজশাহী শহরের এক ছাত্রাবাসের নিজ কক্ষে গলায় ফাঁস দেন সিএসই বিভাগের ১৭ সিরিজের সামিউর রহমান।

এ ছাড়া ১৮ মে রাজধানীর হাজারীবাগের নিজ বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লেভেল-২ টার্ম-১-এর শিক্ষার্থী রাকিবুল হোসেন রাফির মরদেহ।

ঘটনাগুলো দেশে শিশু-কিশোর-তরুণদের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার সামান্য কয়েকটি উদাহরণ। আঁচল ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ জরিপের তথ্য বলছে, এ বছরের প্রথম আট মাসে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের এমন আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩৬১টি। এসব ঘটনার সংবাদে আত্মহত্যার পেছনে নানা কারণ উঠে এলেও বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মূলত পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবহেলা ও অজ্ঞতাই কিশোর-তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে নিজের জীবন নিজেই কেড়ে নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তের দিকে।

বিজ্ঞাপন

আঁচল ফাউন্ডেশনের ওই জরিপে উঠে এসেছে, বছরের প্রথম আট মাসে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলশিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ১৬৯ জন। এ ছাড়া কলেজের ৯৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৬ জন ও মাদ্রাসার ৩০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বয়সের দিক থেকেও সবচেয়ে বেশি ছিল বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষার্থীরা, যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর। আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশই এই বয়সী। বাকিদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী ২১ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর ১২ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীর হার ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।

শিশু-কিশোর-তরুণরা কেন এভাবে আত্মহননের মিছিলে যোগ দিচ্ছে— এমন প্রশ্নের জবাবে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিদ ও শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র সবারই দায় রয়েছে। আমাদের দেশে যেভাবে শিশুদের বড় করে তোলা হয়, তাতে অনেকেই পরিবর্তিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার দক্ষতা অর্জন করতে না পেরে জীবনের ইতি টানছে— এমন অভিমত দিচ্ছেন তারা। বলছেন, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় মানসিক সমর্থন পেলে শিশু-কিশোর বা তরুণদের অনেককেই আত্মহত্যার পথে হাঁটতে হতো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, একজন মানুষের যখন নিজের প্রতি ভালোবাসা থাকে না, তখনই সে নিজের জীবন নিজে নেয়। আমাদের দেশে শিশুদের বড় করে তোলার ভুল প্রক্রিয়া এবং ফলাফলনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি শিশুর এমন ভঙ্গুর মানসিক অবস্থার অন্যতম মূল কারণ। পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য মানবিকতা, দায়িত্ববোধ, সহানূভুতি, অন্যের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া, দয়া, সময়ানুবর্তিতা, সততা, নৈতিকতা, শুদ্ধাচার, সামাজিকতার মতো গুণাবলী থাকতে হয়। অথচ আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থায় ভালো ফলাফল ছাড়া শিশুকে আর কোনো গুণ অর্জনে তাগিদ দেওয়া হয় না। ফলে শিশুর পূর্ণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

বিজ্ঞাপন

আত্মহত্যার পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের দায় প্রসঙ্গে মেহতাব খানম বলেন, শিশুকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকের। শিশু ফুলের কুঁড়ির মতো, যাকে ফুল হয়ে ফুটতে সাহায্য করার কথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা তার কিছুই পায় না। শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য কী কী প্রয়োজন, সে বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করার কথা, শিক্ষকরা তা করছেন না। পাঠ্যবইয়ের বাইরে সহপাঠ বা সহশিক্ষা কার্যক্রম শিশুর বিকাশে অত্যন্ত জরুরি। আজকাল এসব বিষয় ভীষণ অবহেলা করা হয়।

মেহতাব খানম মনে করেন, শিশুরা পরিবারেও অনেক চাপের মধ্যে থাকে। মন খুলে কথা বলতে পারে না। বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীরা অনলাইন-অফলাইনে জড়িয়ে পড়া নানা ধরনের সম্পর্কও সামাল দিতে না পেরেও মানসিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে বলেও মনে করেন তিনি।

মেহতাব খানম বলেন, সব কিছু মিলিয়েই চাপ নিতে না পেরে অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বয়ঃসন্ধির সময়টিই সবচেয়ে সংবেদনশীল সময়। এ সময়ে তাদের সঙ্গে বুঝেশুনে আচরণ করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় মা-বাবারা সন্তানদের সঙ্গে এই সময়েই রূঢ় আচরণ করেন, যার চাপ সন্তানরা নিতে পারে না। টানাপোড়েন দূর করে মা-বাবাকেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে। সম্পর্ক, পড়ালেখা সবকিছু নিয়েই শিশুকে চাপমুক্ত রাখতে হবে। পাশাপাশি সন্তান ইন্টারনেটে যুক্ত থাকলে সেখানে সে কীসের সংশ্রবে থাকছে, সেগুলোও নজরদারিতে রাখতে হবে। সন্তানের সঙ্গে সুস্থ, সহজ ও খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাহলে সন্তানদের হারানোর ভয় অনেকটাই কমে যাবে।

আরও করণীয় তুলে ধরে অধ্যাপক মেহতাব বলেন, সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চাপ সহ্য করার মতো করে তৈরি করতে হবে, যেন তারা বড় হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে টিকে থাকতে পারে। পৃথিবী খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। এর প্রভাব সন্তান-অভিভাবক উভয়ের ওপর পড়ছে। কাছের মানুষের সঙ্গে বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে টানাপোড়েন দূর করতে কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অবশ্যই কাউন্সিলর থাকতে হবে। মা-বাবাকে সন্তান লালন-পালনের পদ্ধতি শিখতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদেও প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা সারাবাংলাকে বলেন, একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার জন্য সবসময় চাপ থাকবে, তা নয়। মানসিক সমস্যাও থাকতে পারে। সামাজিক কারণও নানাবিধ হতে পারে। পত্র-পত্রিকায় আত্মহত্যার যেসব কারণ উঠে আসে তা অনেকসময় আসল কারণ কি না, সেটিও জানার উপায় নেই। তারপরও বলা যায়, তরুণদের মধ্যে, বিশেষ করে মেয়েদের আত্মহত্যার পেছনে যৌন নিপীড়নের একটি বড় ভূমিকা থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পড়ালেখার সঙ্গে প্রাপ্তির হিসাব মিলছে না। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের ওপর পরিবার বা অনেক সময় পুরো গ্রামের প্রত্যাশার চাপ থাকে। সেই প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হবে না বুঝতে পারলে তারা ভেঙে পড়ে। তার ওপর আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারে না। এতে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। সমাজের দ্রুত বদলের প্রভাবও পড়ছে তাদের ওপর।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে শিক্ষাব্যবস্থার দায় কতটুকু— জানতে চাইলে শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ আঞ্জুমান পারভীন বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার অনেক বড় ভূমিকা থাকে। একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করার আগে কিছু লক্ষণ থাকে। সেগুলো দেখে তাকে মানসিকভাবে সমর্থন দিতে হয়। কারণ খুঁজে বের করে পরিবারকে জানানো মানসিক সমর্থন দেওয়া শিক্ষকের দায়িত্ব হলেও এই চর্চা একেবারেই নেই আমাদের দেশে। শিক্ষার্থী বাড়ির কাজ না আনলে বা পড়ালেখা না করলে বকা বা শাস্তি দেন শিক্ষকরা। কিন্তু কেন শিক্ষার্থী পড়ালেখা বা বাড়ির কাজ করতে পারছে না— তার কারণ খুঁজে বের করছেন না।

সচেতনতা ও আইনের কারণে এখন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মারধর না করলেও আচরণগত মৌলিক পরিবর্তন আসেনি বলেই মনে করেন আঞ্জুমান পারভীন। বলেন, কারিকুলাম বদলেছে। শিখন পদ্ধতি বদলেছে। অনেক তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন। কিন্তু আচরণের জায়গায় খুব পরিবর্তন আসেনি। শিক্ষার্থীর আবেগীয় ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিক্ষকদের যে ভূমিকা রাখার কথা, তা তারা রাখছেন না। শিশু হয়তো বাড়িতে মারামারি বা ঝগড়া দেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই সে শেখার অবস্থায় থাকবে না। একজন শিক্ষককে জানতে হবে এই শিশুর সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, কীভাবে তাকে শেখাতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বোঝা ও সে অনুযায়ী আচরণ করা এবং ট্রমা ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে শিক্ষকদের আরও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এই প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রম তৈরিতে অভিভাবকদেরও সংযুক্ত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ড. আজহারুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেই। কোথাও কোথাও থাকলেও চাহিদার তুলনায় সেবা অপ্রতুল। কিছু প্রতিষ্ঠানে খুবই সীমিত আকারে কাউন্সেলিং করা হয়। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অচিরেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত ও পেশাদার বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের মাধ্যমে কাউন্সেলিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং পক্ষপাত ও উদ্বেগহীন শিক্ষাব্যবস্থার পরামর্শ দেন ড. আজহারুল ইসলাম। বলেন, আত্মহত্যা জটিল হলেও প্রতিরোধযোগ্য মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা। মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট অনেক কিছুর জন্য হতে পারে। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে হয়তো আত্মহত্যার ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু ব্যক্তি যে পরিবেশে জীবনযাপন করে তার মধ্যে স্বচ্ছতা, সাম্য ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা না গেলে টেকসই মানসিক স্বাস্থ্য ধরে রাখা কষ্টকর। শিক্ষার্থীদের টেকসই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং পক্ষপাত ও উদ্বেগহীন শিক্ষাব্যবস্থা অপরিহার্য এবং এগুলোর ব্যবস্থা এখনই করতে হবে।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

আত্মহত্যা আত্মহত্যায় প্রভাবক মেহতাব খানম শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর