Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আ.লীগে ডিউক এগিয়ে, আসন পুনরুদ্ধারে শক্ত প্রার্থী খুঁজছে জাপা

রাব্বী হাসান সবুজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২১:৫১

রংপুর: আর মাত্র কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই উত্তরের জেলা রংপুরের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

তবে এক সময়ের প্রচলিত বাণী ‘রংপুরের মাটি, জাতীয় পার্টির ঘাঁটি’ এবং ‘রংপুরের রাজনীতিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদই যে শেষ কথা’- বাস্তবে এখন আর এমন নেই। আগে রংপুর জেলার সবক’টি আসনই জাতীয় পার্টির দখলে থাকতো। কিন্তু এখন সেই চিত্র আর নেই। ছয়টি আসনের মধ্যে টানা মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে জেলার চারটি আসন। বাকি দুটি আসনও নিজেদের দখলে নিতে দীর্ঘদিন থেকেই তৎপর সরকারি দলটি। কিন্তু মহাজোটের শরিক হওয়ায় বার বার রংপুরের এই দু’টি আসন ছেড়ে দিতে হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে। তবে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলটিতে দ্বন্দ্বের সুযোগকে এবার কাজে লাগিয়ে আসন দু’টি দখলে নিতে চায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির তেমন কোনো তৎপরতা নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে রংপুর-২ আসন (বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ) আসনের চিত্র।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: খোঁজ নেই বিএনপির, আ.লীগ-জাপার ভরসা রাঙ্গাঁ!

জেলার তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে রংপুর-২ আসন। ১৯৯১ সালে এই আসন থেকে জাতীয় পার্টির পরিতোষ চক্রবর্তী নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে এ আসন থেকে নির্বাচন করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেবার এই আসন থেকে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। তবে তিনি অন্য আসনে থেকেও নির্বাচিত হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু উপনির্বাচনে জয় পান আওয়ামী লীগের আনিছুল হক চৌধুরী। আর ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ আলী সরকারের কাছে পরাজিত হন তিনি। আর ২০০৮ সালে আমেরিকাপ্রবাসী আনিছুল ইসলাম মন্ডলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ওই নির্বাচনে আনিছুল ইসলাম মন্ডল মহাজোটের প্রার্থী হয়ে জামায়াতের প্রার্থী আজহারুল ইসলামকে পরাজিত করে এমপি হন। এর পর ২০১৪ সালে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপার প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে আওয়ামী লীগের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ওরফে ডিউক চৌধুরী বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে এ আসন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতেও আওয়ামী লীগের ডিউক চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হন।

তবে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ডিউক চৌধুরীর সময় এলাকায় কিছুটা উন্নয়ন হলেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দলীয়-পারিবারিককরণ, ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করা, করোনাকালে এলাকায় না থাকাসহ নানা কারণে তার প্রতি মানুষের অনেকটা অনীহা চলে এসেছে। এ সব কারণে বিগত ইউপি নির্বাচনে বদরগঞ্জে ১০ ইউনিয়নের সাতটিতে এবং তারাগঞ্জে পাঁচটি ইউনিয়নের মধ্যে চারটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যানপ্রার্থী হেরে যান।

আর এ কারণেই টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে এবার মনোনয়ন প্রত্যাশী কয়েকজন। এই আসনে ফের মনোনয়ন চাইবেন বর্তমান এমপি যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডিউক চৌধুরী। এ ছাড়াও মনোনয়ন দৌড়ে আছেন- বদরগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ বিশ্বনাথ সরকার বিটু, ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী ও রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সুমনা আক্তার লিলি।

তারাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জালাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ইউপি নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ কারণে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটে। বলা চলে নেতৃত্বের অভাবে রংপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা কমেছে।’

তারাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিয়ার রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই আসনটি অনেক বড়। আওয়ামী লীগ বৃহৎ একটি দল। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবেই। দল যাকে মনোনয়ন দেবে আমরা নেতাকর্মীরা তার পক্ষেই কাজ করব।’

এ বিষয়ে বিশ্বনাথ সরকার বিটু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মাঠে আছি। এলাকার মানুষের সঙ্গে রয়েছি। নেত্রী যদি নমিনেশন দেন তাহলে নির্বাচন করব।’

সম্ভাব্য মনোনয়ন নিয়ে সুমনা আক্তার লিলি সারাবাংলাকে বলেন, ‘’আমি তৃণমূলে থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির পর এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছি। রাজনীতিতে নারীরা বর্তমানে সফল হচ্ছে। তাদের সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করছেন, নারীদের মূল্যায়ন করছেন। একজন নারী হিসেবে আমার কোটা আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এলাকার জনগণ আমার পাশে আছে। জনগণের সমর্থনে এগিয়ে যেতে চাই। দলীয় নেত্রীর কাছে এবার এ আসনের জন্য নৌকার মনোনয়ন চাইব।’

রংপুর-২ আসনে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন বরাদ্দের কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে টিআর-কাবিখা প্রকল্প ছাড়া এ আসনে কোনো উন্নয়ন হয়নি। স্কুল-কলেজে নিয়োগ বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন স্থানীয় এমপি ও তার সিন্ডিকেট। আমি জনগণের সমর্থনে এগিয়ে যেতে চাই। দলীয় নেত্রীর কাছে নৌকার মনোনয়ন চাইব।’

মনোনয়ন প্রসঙ্গে রংপুর-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ডিউক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার আসনে গত ১০ বছরে যত উন্নয়ন হয়েছে বিগত কোনো এমপির আমলে হয়নি। এজন্য এবারও দলীয় প্রধানের কাছে মনোনয়ন চাইব। আশা করি ফের তিনি আমাকে মনোনয়ন দেবেন।’

এদিকে, এই আসনের ভোটাররা জানিয়েছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন রাষ্ট্রপতি ও রংপুর-২ (বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ) আসনের এমপি ছিলেন তখন দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হয়নি। তবে এরশাদের জনপ্রিয়তার কারণে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে তার দেওয়া প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে এই আসনে এমপি বানিয়ে আসছিলেন কর্মী-সমর্থকেরা। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর পর এই আসনটিতে জাতীয় পার্টিতে বড় ধরনের ধস নামে। যার বড় উদাহরণ বিগত ইউপি, পৌর ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মেয়র ও চেয়ারম্যানপ্রার্থী দিতে না পারা। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে একসময়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলটি খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নাই। এমনকি তাদের প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়েও শক্তিশালী নয়। তবে এই আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন পেতে ইতোমধ্যেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য ও সাবেক এমপি আনিসুল ইসলাম মন্ডল, রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক মোকাম্মেল হক চৌধুরী।

এ বিষয়ে জাপা নেতা মোকাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে জাতীয় পার্টির অবস্থান মোটামুটি ভালো। দল মনোনয়ন দিলে এমপি নির্বাচিত হব। তবে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাব না।’ বদরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব মাসুদ রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘তারাগঞ্জ-বদরগঞ্জ এখনও জাতীয় পার্টির কর্মী-সমর্থক সবচেয়ে বেশি। এখানে মহাজোটের বাইরে গিয়ে জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে নির্বাচন করলেও প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত।’

এই আসনটিতে এক সময়ের রাষ্ট্র পরিচালনা করা দল বিএনপির খানিকটা অবস্থান থাকলেও নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিক মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে মাঠে নামতে পারছেন না। তবে বিএনপি নির্বাচনে গেলে উপজেলা বিএনপির সদস্য ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকার, জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ও বর্তমান বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি পরিতোষ চক্রবর্তী, বদরগঞ্জ পৌর বিএনপির সহসভাপতি ও বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম রছুল বকুল এই আসনের জন্য মনোনয়ন চাইবেন। তাদের দাবি, দল যদি নির্বাচনে যায়, আর যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে এই আসনে বিএনপি বিজয়ী হবে।

বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি পরিতোষ চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই আসনে তেমন কোনো উন্নয়নই হয়নি। গত ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। যা উন্নয়ন হয়েছে সেটা স্বাভাবিক। আমি সংসদ সদস্য থাকাকালীন দুই উপজেলার যা উন্নয়ন করেছি বর্তমানের কেউ তা করতে পারেনি। তাই এই আসনের মানুষ বিএনপিকে ভোট দিতে উদগ্রীব হয়ে আছে। কারণ, বিএনপির আমলে উন্নয়ন হয়।’

বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন সাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই আসনে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। তাই নির্বাচন হলে জনগণ বিএনপিকে ভোট দেবে।’ এদিকে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের জেলা সভাপতি ও তারাগঞ্জ হারিয়ারকুঠির ইউপির চেয়ারম্যান কুমারেশ রায় নির্বাচনের অংশ নিতে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছেন বলে জানান তিনি।

রংপুর-২ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭২ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৬০ জন পুরুষ, ১ লাখ ৭৭ হাজার ৩০৫ জন নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন সাত জন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে জয়লাভ করেন আনিছুল ইসলাম মন্ডল। তিনি ভোট পান ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৭১টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীর এ টি এম আজহারুল ইসলাম পান ৩৬ হাজার ৫৮৬ ভোট। ২০১৪ সালের ১০ জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের ডিউক চৌধুরী। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি জয় লাভ করেন। সেই নির্বাচনে ডিউক চৌধুরী পান ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৬৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মোহাম্মদ আলী সরকার ধান শীষ প্রতীক নিয়ে পান ৫৩ হাজার ৩৫০ ভোট।

সারাবাংলা/আরএইচএস/পিটিএম

আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ডিউক চৌধুরী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিতোষ চক্রবর্তী বিশ্বনাথ সরকার বিটু মোকাম্মেল হক চৌধুরী রংপুর-২ (বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ) শাখাওয়াত হোসেন সাহান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর