স্বাধীন দেশে ‘পরাধীন’ এক গ্রাম!
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:১৩
বগুড়া: এ যেন স্বাধীন দেশে পরাধীন এক গ্রাম। গ্রামে প্রায় ৪০০ পরিবারের বসবাস। এরমধ্যে তিনশ’ পরিবারই প্রায় দুই যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। দিনের পর দিন উচ্ছেদ আতঙ্কে কাটে এখানকার মানুষের। প্রতিবাদের চেষ্টা করলেই করা হয় পুলিশি হয়রানি! মামলা, হামলা, গ্রেফতারের শিকার হয়ে এখন প্রতিবাদ করার সব সাহসও হারিয়ে ফেলেছে মানুষগুলো। সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের স্থিতাবস্থার আদেশ লঙ্ঘন করে একটি ভূমিহীন পরিবারের বসতবাড়ি ভেঙে লুট করা হয়েছে। লুটপাটের প্রতিবাদ করায় উল্টো মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করতে হয়েছে পরিবারের সদস্যদের।
এসব ঘটনা বগুড়ার শেরপুর উপজেলার একটি প্রাচীন জনপদ ভবানীপুরের। নাটোরের রাণী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত এই গ্রামের প্রায় তিনশ’ পরিবার স্থানীয় একটি মন্দির পরিচালনা কমিটির হাতে বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। স্থানীয় মুসলমান পরিবারসহ নিম্নবর্ণের হিন্দু, আদিবাসী কেউই রেহাই পাননি তাদের হাত থেকে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের স্থিতাবস্থার আদেশ লঙ্ঘন করে মন্দিরের কেয়ারটেকার অপূর্ব চক্রবর্তী ভূমিহীন আলতাফ হোসেনের বসতবাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করে। এসময় আলতাফ হোসেনের ছেলে সেলিম থানায় ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চান। পুলিশ এসে উল্টো আলতাফ হোসেনের ভাগ্নে মামুনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে সন্ধ্যার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও পরদিন মন্দির কমিটির লোকেরা বাড়িটি ভেঙে যাবতীয় মালামাল লুট করে বলেও অভিযোগ ওঠে।
জানা যায়, বিরোধের শুরু ২০০২ সালে। মন্দির কমিটি তখন ভবানীপুর মৌজার ১নং সিএস খতিয়ানভুক্ত প্রায় ৪৬ একর জমি শ্রী শ্রী ভবানী বিগ্রহের মর্মে দাবি করে। এসব সম্পত্তির মধ্যে গ্রামের প্রায় তিনশ’ ভূমিহীন পরিবার গত ৫০ থেকে ৬০ বছর যাবত বসবাস করছেন। এই ৩০০ পরিবারের অর্ধেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
এছাড়া নালিশি এসব ভূমির মধ্যে ইউনিয়ন ভূমি অফিস, ডাকঘর, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, এমপিওভুক্ত হাইস্কুল, হাট-বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে।
সরেজমিনে মন্দির কমিটির বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা যায়, ২০০৪ সালে মন্দির পরিচালনা কমিটি মন্দিরের প্রাচীর ভেঙে মন্দিরে রক্ষিত ২টি বড় মাপের লোহার সিন্দুক, কাঁসার বাসনপত্র, স্বর্ণের গহণা, বেশকিছু গাছপালাসহ অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকযোগে বগুড়ায় নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন মন্দিরের কার্যকরী সদস্য বগুড়ার সিনিয়র সাংবাদিক, বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী। এর কিছুদিন পরই ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে নিজ বাড়ির সামনে খুন হন তিনি।
এক যুগ পর পুলিশ দীপঙ্কর হত্যায় জেএমবিকে দায়ী করে প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে তার পরিবারের সদস্যরা পুলিশের এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন। মন্দিরের মালামাল লুটের এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন মন্দিরের তখনকার পুরোহিত ষষ্ঠী ঠাকুর। কিন্তু ষষ্ঠী ঠাকুরকে মন্দির কমিটির লোকেরা উল্টো দীপঙ্কর হত্যার সন্দেহভাজন আসামি করে। রিমান্ড ও কারাভোগে অসুস্থ হয়ে কিছুদিন পর তিনি মারা যান।
এছাড়া নিজের বাড়ির গাছ কাটায় ২০০৫ সালে ব্যবসায়ী নীলমনিসহ কয়েকজনকে গাছ চুরির দায়ে আসামি করে বগুড়ার শেরপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করে মন্দির কমিটি। মামলায় তারা জেল খেটে কিছুদিন পর জামিনে মুক্তি পান। মুক্তির কিছুদিন পর ভয়ে সপরিবারে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমায় নীলমনির পরিবার।
সরকারি খাস পুকুরে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে নিয়ে মাছ চাষ করতেন জেলা ছাত্রলীগ নেতা কাফি। এসব পুকুর মন্দিরের দাবি করে ২০১৮ সালে কাফির বিরুদ্ধে লুটতরাজের একটি মামলা দায়ের করে মন্দির কমিটি। এই মামলায় বেশকিছুদিন জেল খাটার পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। কাফি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রফিকুল ইসলাম বুলুর ছেলে।
গ্রামের আরেকজন সাধারণ কৃষক মহাদেব সাহা। নিজ জায়গায় বাড়ি করতে গেলে মন্দির কমিটি তাকে ও তার সন্তানদের নামে আরেকটি মামলা দায়ের করে। মামলায় ভীত হয়ে ভয়ে পরিবারটি নিজের জায়গায় ঘরও তুলতে পারছে না।
গ্রামের নাইওর পাড়ে বসবাস করেন হিন্দু ও সাঁওতাল আদিবাসীসহ প্রায় ৫০টি ভূমিহীন পরিবার। ‘নাইওর পুকুর’ বৃটিশ আমল থেকেই সরকারি ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর। উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে বাৎসরিক লিজ নিয়ে এসব ভূমিহীন পরিবার সমবায়ভিত্তিক মাছ চাষ করে জীবীকা নির্বাহ করেন। কিন্তু ২০১২ সালে মন্দির পরিচালনা কমিটি পুকুরটি মন্দিরের দাবি করে ভূমিহীনদের বসতবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে ইউএনও’র হস্তক্ষেপে ভূমিহীনরা সে যাত্রায় রক্ষা পান।
এছাড়া দাগ নম্বর জালিয়াতির মাধ্যমে গত ২০২১ সালে একতরফা একটি রায়ের মাধ্যমে ভূমিহীন আলতাফ হোসেনের বাড়ির চারপাশে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়ে যায় পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন। এরপর তিনিসহ গ্রামের ২৯ জন মিলে ২০২২ সালের জুন মাসে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করলে, হাইকোর্ট রুল জারিসহ স্থিতাবস্থার আদেশ দেন। কিন্তু মন্দির কমিটি হাইকোর্ট বিভাগের সেই আদেশ লঙ্ঘন করে গত ৪ সেপ্টেম্বর বাড়িটি ভেঙে নিয়ে যায়।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাচীর তুলে বাড়িটি অবরুদ্ধ করে কমিটির লোকেরা। এ সময় বাধা দিতে গেলে মন্দির পরিচালনা কমিটির সদস্য দিলীপ কুমার দেব মন্দিরের প্রাচীর ভাঙচুরের অভিযোগে শেরপুর থানায় আলতাফ হোসেনের ছেলে সেলিম সরকার, ভাগ্নে মামুন শেখ ও সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল হান্নান খন্দকারকে আসামি করে শেরপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ৯ দিন কারাভোগের পর ভুক্তভোগী সেলিম জামিনে মুক্তি পান।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও স্থানীয় অধিবাসী রফিকুল ইসলাম বুলু বলেন, ‘মন্দির নিয়ে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। মন্দিরে যথারীতি পূজাপার্বন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মন্দিরটি ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত সম্পত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এটা একটা সরকারি মন্দির। বর্তমানে এই মন্দিরের সভাপতি জেলা প্রশাসক এবং সাধারণ সম্পাদক উপজেলা নির্বাহী অফিসার। কিন্তু তারা ডিসি ও ইউএনও’র কোনো কথা শোনে না। মন্দির কমিটির কতিপয় সদস্য মিথ্যা মামলা, হামলা ও হয়রানি করে আমাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে গ্রামটিকে বিরানভূমি বানাতে চাচ্ছেন। এদের সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা জড়িত।’
তবে মন্দির কমিটির দাবি করা কাগজপত্রকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে গ্রামবাসীর পক্ষে রিট করেছেন সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল হান্নান খন্দকারসহ ২৯ জন। আব্দুল হান্নান বলেন, ‘মন্দির কমিটির নির্যাতনে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তারা সংখ্যালঘুর দোহাই দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে আমাদের উপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। অতীতে এসব সম্পত্তি কখনোই দেবোত্তর খতিয়ানভুক্ত ছিল না। এসব সম্পত্তি বৃটিশ আমল থেকেই ১নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত সম্পত্তি। আদালত আমাদের রিট আবেদন মঞ্জুর করে রুল জারি করেছেন এবং নালিশি সম্পত্তির উপর স্থিতাবস্থার আদেশ জারি করেছেন।’
বগুড়ার জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম থেকে জানা যায়, ১৯৩০ সালে প্রণীত ক্যাডেস্টাল সার্ভে বা সিএস রেকর্ড ১নং খতিয়ানভূক্ত। এসব সম্পত্তি ভারত সম্রাটের নামে এবং দখলকার হিসাবে ‘জমিদার বীরেন্দ্র নাথ রায়, পিতা জিতেন্দ্র নাথ রায়, সাং নাটোর, জেলা রাজশাহী’ লেখা রয়েছে। এসব সম্পত্তি বৃটিশ আমল থেকেই সরকারি সম্পত্তি। তৎকালীন জমিদার সরকারি সম্পত্তির উপরই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন।
পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালের ১৪ এপ্রিল জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে ‘৪৮৩৯ এলআর গেজেট নোটিফিকেশন’মূলে তা অধিগ্রহণ করা হয়। সেই অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ পক্ষে কালেক্টর, বগুড়ার নামে স্টেট অ্যাকুইজিশন রেকর্ড বা এসএ রেকর্ড ১নং খাস খতিয়ান হিসাবে চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো. শামছুল হক জানান, প্রেসিডেন্ট অর্ডার নং ৯০/১৯৭২ অনুযায়ী সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করা সম্পত্তির বিরুদ্ধে কোনো মামলা করার বিধান নেই। আদেশে বলা হয়েছে, “জমিদারি উচ্ছেদ প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে কোনো সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে দেশের কোনো আদালতে কোনো মামলা মোকর্দ্দমা করা যাবে না। কোনো মামলা চলমান থাকলে তাও বাতিল বলে গণ্য হবে। কোনো আদালত অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে কোনো রায় দিলে সেই রায়েরও আইনগত কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।”
স্থানীয় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, মন্দির পরিচালনা কমিটি অধিগ্রহণের এই তথ্য এবং প্রেসিডেন্ট অর্ডারের বিষয়টি গোপন করে সরকারি কৌঁশুলির সঙ্গে যোগসাজসে এসব সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে গত ২০০২ সালে বগুড়ার যুগ্ন জেলা জজ আদালতে একটি স্বত্ব ঘোষণার মোকর্দ্দমা দায়ের করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে এসব সম্পত্তির একটি অংশ স্থানীয়দের মাঝে সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়েছেন। এসব জায়গায় ভূমিহীনদের বসতবাড়ি। এরপরও এসব জমির মালিককে মোকর্দ্দমায় পক্ষভুক্ত না করে গোপনে মামলা পরিচালনা করে, মন্দির কমিটি একটি একতরফা রায় হাতিয়ে নেয়।
রায়ের পর বিষয়টি জানতে পেরে স্থানীয়রা হাইকোর্ট বিভাগে ফার্স্ট আপিল দায়ের করেছেন। যা বর্তমানে বিচারাধীন বলেও জানা গেছে। ভুক্তভোগীদের আশা আদালতের রায় তাদের পক্ষেই আসবে, ঘুচবে স্বাধীন দেশে পরাধীন থাকার যন্ত্রণা।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্দির কমিটির কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সারাবাংলা/এমও