জ্বালানি তেল: সুযোগ পাবে বেসরকারিখাত, শিগগিরই নীতিমালা বাস্তবায়ন
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:১৬
ঢাকা: দেশে জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করতে যাচ্ছে সরকার। এ উদ্দেশে বেসরকারিখাতের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, ‘বেসরকারি পর্যায়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুদ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণন নীতিমালা-২০২৩’ এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই এটি বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই নীতিমালা করা হলে জ্বালানি তেলের ওপর সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ আর থাকবে না।
নীতিমালার প্রধান উদ্দেশ্য, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ের ভূমিকার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ততা ও এ খাতের পরিধি বাড়ানো। পাশাপাশি জ্বালানি খাতে দেশীয় সক্ষমতা বাড়ানো, যুগোপোযোগী প্রযুক্তির ব্যবহার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো।
তবে খসড়া নীতিমালায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, উদ্যোক্তাদের জ্বালানি পণ্য খাতের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের গত ৫ বছরের মধ্যে যেকোনো ৩ বছরে প্রতিবছর টার্নওভার কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা বা সমমূল্যের মার্কিন ডলারে হতে হবে।
বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে দেশে নিজস্ব কিংবা যৌথ মালিকানায় বার্ষিক কমপক্ষে ১৫ লাখ টন ক্ষমতাসম্পন্ন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন বা প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতাসম্পন্ন রিফাইনারি স্থাপন করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বা তার কোনো পরিচালক ঋণখেলাপি হতে পারবে না।
আরও শর্তের মধ্যে রয়েছে, উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আদালতে এই সংক্রান্ত কোনো মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় থাকতে পারবে না। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক সংস্থা (জাতিসংঘ, ওপেক, ডব্লিউটিও ইত্যাদি) কর্তৃক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হতে হবে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
খসড়া নীতিমালায় জ্বালানি তেল আমদানি প্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে, বেসরকারি পর্যায়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হলে লাইসেন্স প্রাপ্ত এবং সরকারি অনুমতি প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সঙ্গে আবশ্যিকভাবে চুক্তি করতে হবে এবং নির্ধারিত হারে রয়্যালিটি বিপিসিকে দিতে হবে।
আমদানি পরিকল্পনা ও প্ল্যান্টের পরিশোধন/প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতার অধিক বা অনুমোদিত পরিমানের বেশি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা যাবে না। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি ও পরিশোধনের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশ এবং সব বিধি-বিধান ও পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ এবং প্রতিপালন করতে হবে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ ও বিপণনের জন্য সরকারকে নির্ধারিত ট্যাক্স, ভ্যাট, অন্যান্য শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে বণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত দেশ হতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা যাবে না। আরও বলা হয়েছে, আমদানি করা অপরিশোধিত তেল শুধুমাত্র প্ল্যান্টের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। অপরিশোধিত তেল কোনভাবেই দেশের অভ্যন্তরে অন্য কোথাও, খোলা বাজার, অন্য কোনো প্ল্যান্টে বিক্রয়, সরবরাহ বা রফতানি করা যাবে না।
বেসরকারিখাতের ব্যবসায়ীদের রিফাইনারি স্থাপনের জন্য কমপক্ষে ৮০ একর জমি থাকতে হবে বলে নীতিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে এবং রিফাইনারির অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ২ লাখ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্টোরেজ সুবিধা থাকতে হবে। রিফাইনারি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর, বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর আগে নিরাপত্তা গ্যারান্টি হিসেবে বিপিসির অনুকূলে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে ২৫০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর নিজস্ব মালিকানায় বা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লাইটারেজ জাহাজ, কোস্টাল ট্যাঙ্কার ও ট্যাংক লরি থাকতে হবে।
খসড়া নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, বেসরকারি রিফাইনারিতে উৎপাদিত ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল বিপণন শুরুর প্রথম ৩ বছর মোট উৎপাদিত জ্বালানি তেলের ৬০ শতাংশ সরকার-নির্ধারিত মূল্যে বিপিসিকে সরবরাহ করতে হবে। বাকি ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ও নিজস্ব নিবন্ধিত বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। তবে বিক্রয় নেটওয়ার্কের স্বল্পতায় কোনো বেসরকারি রিফাইনারি ৪০ শতাংশ তেল বিক্রি করতে না পারলে- এর যেকোন পরিমাণ তেল বিপিসির কাছে বিক্রি করতে পারবে।
পরবর্তী ২ বছরে বেসরকারি রিফাইনারিগুলো তাদের উৎপাদিত তেলের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিক্রি করতে পারবে। আর প্রথম ৫ বছর পর উৎপাদিত জ্বালানির কত অংশ তারা বিপিসিকে সরবরাহ করবে তা পর্যালোচনা করে ঠিক করা হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, বিপিসির চাহিদা না থাকলে বা নিজস্ব বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রির পর উদ্বৃত্ত জ্বালানি তেল ব্যবসায়ীরা বিদেশে রফতানি করতে পারবে।
বেসরকারি উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত জ্বালানি তেল বিক্রি করতে দেশব্যাপী সড়ক, মহাসড়ক, উপজেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোয় পেট্রল পাম্প স্থাপন করতে পারবেন বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। এসব পেট্রল পাম্পে সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করা যাবে।
এদিকে বেসরকারিখাতের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। আগ্রহ প্রকাশ করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি ও পরিশোধন করতে রিফাইনারি স্থাপনের অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে জানান, বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। তবে সেসব এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি।
নীতিমালা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি মোটামুটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, দেশে যে পরিমান জ্বালানি তেল সরবরাহ হয়, তার পুরোটাই সরকার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মাধ্যমে করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে ১৯৬৮ সালে স্থাপিত দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল পরিশোধন কোম্পানি- ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করছে। এই রিফাইনারির বছরে পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন, যা দিয়ে দেশের মোট চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ মেটানো যায়। বাকি ৮০ ভাগ চাহিদা মেটানো মেটানো হয় পরিশোধিত তেল আমদানি করে।
দিন দিন চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আরেকটি রিফাইনারি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বিপিসি। ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ স্থাপনের প্রকল্পটি ২০২৭ সাল নাগাদ নির্মাণ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন বিপিসি কর্মকর্তারা।
বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আরও ৩০ লাখ টন ক্রুড অয়েল পরিশোধন করা সম্ভব হবে। ফলে জ্বালানি তেল সরবরাহ ও মজুদ সংক্রান্ত যে সংকট দেখা দিত তা অনেকটাই কমে আসবে।’
সারাবাংলা/জেআর/এমও