দেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু টিকার ‘সফল’ গবেষণা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:০৬
ঢাকা: দেশে প্রথমবারের মতো একটি সম্ভাবনাময় ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।
প্রতিষ্ঠানটির দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের সঙ্গে পরিচালিত এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই উপযোগী তাদের ভ্যাকসিন যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘টিভি-০০৫’।
সম্প্রতি দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে আইসিডিডিআর,বি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গবেষণায় ব্যবহৃত এক ডোজের ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫ মূল্যায়ন করে দেখা গেছে, এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম।
গবেষকরা জানান, ২০১৫ সালে ডেঙ্গু ইন ঢাকা ইনিশিয়েটিভ (ডিডি) নামক গবেষণাটি শুরু করেন আইসিডিডিআর,বি এবং ইউভিএমের ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টারের গবেষকরা। এই সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল ডেঙ্গু টিকার উন্নয়নে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ২০১৫ থেকে ক্লিনিকাল ট্রায়াল, ল্যাবরেটরি পরীক্ষণ অবকাঠামো এবং প্রারম্ভিকভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অধ্যয়ন সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য আইসিডিডিআর,বিতে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি করা হয়।
আইসিডিডিআর,বি-র সঙ্গে এই সহযোগিতামূলক কাজের আগে, ইউভিএম ভিটিসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কয়েক ডজন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পরিচালনা করেছে যা মূলত ডেঙ্গু টিকার একক ও টেট্রাভ্যালেন্ট ফর্মুলেশন এবং কনট্রোলড হিউম্যান চ্যালেঞ্জ মডেলের ছিল। আইসিডিডিআর,বির গবেষকদের মধ্যে প্রধান গবেষক হিসেবে রয়েছেন সিনিয়র বিজ্ঞানী রাশিদুল হক। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মো. শফিউল আলম, সাজিয়া আফরিন ও মো. মাসুদ আলম।
এ বিষয়ে আইসিডিডিআর,বির গবেষক ড. রাশিদুল হক বলেন, একটি কার্যকর এবং টেট্রাভালেন্ট ডেঙ্গু টিকা বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণে টিভি-০০৫ টিকার গবেষণা করতে পেরে আমরা গর্বিত। আশা করি আমাদের কাজ ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর টিকা প্রাপ্তির বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করবে।
দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেসে প্রকাশিত এই গবেষণাটি একটি দৈবচয়ন ভিত্তিক কাজ এবং ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এর মাধ্যমে টিভি-০০৫ টেট্রাভ্যালেন্ট লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড ডেঙ্গু টিকার নিরাপত্তা, ইমিউনোজেনিসিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির সক্ষমতা এবং তিন বছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্বের অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়েছে। গবেষকরা ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন বয়সের (বয়স ১- ৪৯ বছর) ১৯২ জন স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারীকে চারটি ভাগে ভাগ করে ৩ঃ১ টিভি-০০৫ টিকা বা প্লাসিবো প্রদান করেছেন। এরপর তারা পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন।
এতে আরও বলা হয়েছে, টিকা দেওয়ার পর বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে চারটি ডেঙ্গুর সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। যদিও গবেষণাটির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত করা যায়নি। গবেষণালব্ধ এই ফলগুলো ডেঙ্গুপ্রবণ জনগোষ্ঠীতে ব্যাপকহারে টিভি-০০৫ ডেঙ্গু টিকা ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি, তৃতীয় ধাপের কার্যকারিতা ট্রায়াল পরিচালনার জন্য সমর্থন জোগাড় করতে সহায়তা করবে।
প্রসঙ্গত, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাস যা বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির মৃদু লক্ষণে জ্বর ও হাড়ের ব্যথা হয় এবং গুরুতর ক্ষেত্রে শক, রক্তপাত ও অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটে। সাধারণত ডেঙ্গুর চারটি ধরন (ডেন ১, ২, ৩, ৪) বা সেরোটাইপ এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে সক্রিয় থাকতে পারে। ডেঙ্গুর যেকোনো ধরন একজন মানুষকে অসুস্থ করতে পারে। তবে অন্য কোনো ধরনে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থা গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের (এনআইএইচ) তৈরি ডেঙ্গু টিকার মূল্যায়ন করে আসছে ইউভিএমের ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টার। ইউভিএম টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রফেসর বেথ কির্কপ্যাট্রিক। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মেরি ক্লেয়ার ওয়ালশ, ক্রিস্টেন পিয়ার্স, ডোরোথি, শন ডিয়েল ও মারিয়া কারমোলি। তাদের ডেঙ্গু টিকা প্রোগ্রামটি ইউভিএম ভিটিসি এবং এনআইএইচের ভাইরাল ডিজিজেস ল্যাবরেটরির সিনিয়র গবেষক স্টিফেন হোয়াইটহেড (যিনি একজন ভাইরোলজিস্ট এবং টিভি-০০৫ টিকার উদ্ভাবকদের একজন) এবং জনস হপকিন্স স্কুল পাবলিক হেলথের আন্না ডারবিন এমডির সঙ্গে একটি দীর্ঘ পারস্পরিক সহযোগিতার ফসল।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি, এখানে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত বেশ গুরুতর এবং ঢাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এটি ভয়ানক প্রভাব ফেলছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। অনেক দেশে আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে তরল খাদ্য গ্রহণ এবং উপসর্গ নিয়ন্ত্রণই ডেঙ্গুর একমাত্র প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাই বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী টিকা উন্নয়ন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
সারাবাংলা/এসবি/এনইউ