পরিবারেই সূচনা লিঙ্গ বৈষম্য, ইতিবাচক মনোভাব তৈরির তাগিদ
৬ অক্টোবর ২০২৩ ১০:৫৫
কক্সবাজার: জেন্ডার বা লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে সারাদেশের মতো কক্সবাজারেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে। নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিতে অব্যাহত রয়েছে প্রচেষ্টা। এরপরও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক পরিবারে চলছে লিঙ্গ বৈষম্যের চর্চা। অভিভাবকসহ স্বজনরাই মেয়ে ও ছেলে সন্তানের মধ্যে সমতার পার্থক্য করছেন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের ফলে পরিবারেই তৈরি হচ্ছে লিঙ্গ বৈষম্য। পরিবারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির আগ পর্যন্ত লিঙ্গ বৈষম্য নির্মূল হবে না বলেও মনে করছেন তারা।
পরিচয় প্রকাশ করা হবে না— এমন শর্তে রাজি হলে বেশকিছু পরিবার কথা বলেছে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। ওইসব পরিবারের সদস্যরা বলছেন, অনেকে পরিবারই ছেলে ও মেয়ে শিশুর মধ্যে সমতার কথা বললেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বেশির ভাগ পরিবারেই লিঙ্গ বৈষম্যের চর্চা রয়েছে। কোনো পরিবার জেনে বুঝেই এই বৈষম্যের চর্চা করলেও অনেক পরিবারেরই এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাকে তারা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছেন। এর ফলে যে পরিবারেরই মেয়ে সন্তানটি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, সে বিষয়ে তারা একদমই সচেতন নন।
শহরের বৈদ্যঘোনার এক পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। এই পরিবারে সন্তান তিনটি— দুটি মেয়ে, এক ছেলে। তাদের মধ্যে ছেলেটি মেজ সন্তান। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেটিকে ‘ভালো পড়ালেখা করাতে’ ভর্তি করা হয়েছে বেসরকারি একটি কিন্ডারগার্টেনে। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার একটি কোর্সেও তাকে ভর্তি করা হয়েছে। কিনে দেওয়া হয়েছে সাইকেল। তার যেকোনো ইচ্ছা পরিবারের কাছে অগ্রাধিকার পায়।
ওই পরিবারেরই বাকি দুই মেয়ে সন্তানের জন্য চিত্রটি একদমই ভিন্ন। কোনোমতে যেন তারা পড়ালেখা করতে পারে, সে কারণে ভর্তি করা হয়েছে বাড়ির পাশের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাদের একজন পরীক্ষায় ভালো ফল করার পর সাইকেলের আবদার করলে তাদের মা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, মেয়েদের সাইকেল চালাতে হয় না।
পড়ালেখা থেকে শুরু করে খাবার-দাবার নিয়েও কন্যাশিশুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে দেখা গেছে অনেক পরিবারেই। মেয়েদের পড়ালেখার প্রয়োজন নেই, তারা ঘরের কাজ জানলেই হবে— এমন ধারণা থেকেও বের হতে পারেননি অনেকেই।
শহরের পেশকার পাড়ার বয়স্ক এক নারী বললেন, মেয়েদের আবার কীসের লেখাপড়া? তারা ঘর থেকে কেন বের হবে? পুরুষরা ঘরের বাইরে চাকরি-ব্যবসা করে আয় রোজগার করবে। আর মেয়েরা ঘরে রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালন ও স্বামীর দেখাশুনা করবে। কিন্তু এখন দেখছি জামানা পাল্টে গেছে। এই লক্ষণ ভালো না।
তবে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এই বৈষম্যের বিষয়টি এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন। তারা মেয়ে শিশুকেও সমান গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সদর উপজেলা খুরুশকুলের তেমন এক গৃহবধূ (নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি) সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার খুবই ইচ্ছা ছিল বড় ভাইয়ের মতো লেখাপড়া করে চাকরি করব। আমি ছাত্রী হিসেবে খারাপ ছিলাম না। কিন্তু পরিবারের কারণে বেশি লেখাপড়া করতে পারিনি। ১৮ বছরের আগেই বিয়ে দিয়েছিল। এরপর আর কিছু করার ছিল না। দুই মেয়ে নিয়ে সংসার চলছে। তবে আমার মেয়েদের জীবন এমন হতে দেব না।
এদিকে সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও যেসব নারী কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছেন, তাদেরও বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে নানাভাবে। কক্সবাজার শহরের শুঁটকি পল্লীর নারী শ্রমিক রাবেয়া খাতুন বলেন, নারীদের অধিকারের কথা বই আর জ্ঞানী ব্যক্তিদের মুখেই সীমাবদ্ধ। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলায়ে শুঁটকি পল্লীতে কাজ করি। কিন্তু তারা (পুরুষরা) পায় ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা, আর আমরা পাই সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। এর চেয়ে বড় বৈষম্য আর কী হতে পারে?
লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে পরিবারের ভূমিকার কথা তুলে ধরে জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী শাকী-এ কাউছার বলেন, এই আধুনিক যুগেও নানা কুসংস্কার, ধর্ম নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা, চাকরিতে লিঙ্গ বৈষম্য দূর হচ্ছে না। আর এগুলো তৈরি হচ্ছে পরিবার থেকেই। অনেক মা-বাবা নিজেদের অজান্তে কোমলমতি শিশুদের মনে বপন করছে বৈষম্যের বীজ। তারা কন্যাশিশুর হাতে তুলে দিচ্ছে পুতুল আর রান্নার চামচ, অন্যদিকে ছেলে সন্তানকে দিচ্ছে বাজারের টাকাসহ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এভাবে শৈশব থেকেই শিশুদের মধ্যে বৈষম্যমূলক মানসিকতা গড়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার থেকেই ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি না হলে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা ও কাছের স্বজনদেরই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে।
কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীদের অবস্থান। এরপরও কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য দূর হচ্ছে না। শিক্ষায় সমতা আনতে ছাত্রীদের উপবৃত্তিসহ বাস্তবমুখী নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবুও বিদ্যালয় থেকে ছাত্রী ঝরে পড়ার হার কম নয়। সঙ্গে রয়েছে অল্পবয়সী কন্যা শিশুদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। এগুলো রোধ করতে হবে।
লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে কাজ করছে রিসার্চ ট্রেনিং ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল (আরটিএমআই)। সংস্থাটির প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর নাসরিন আক্তার মনিকা বলেন, পরিবারের সচেতনতার মধ্য দিয়েই লিঙ্গ বৈষম্যকে নির্মূল করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের সংস্থা মা সভা, মাঠ পর্যায়ে কাউন্সেলিংসহ বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়ে কাজ করছে।
‘বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘে’র প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর সঞ্চিতা মল্লিক বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো অনেকের ধারণা, নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারবে না। নারীদের কাজ ঘরে থাকা। বাইরের সব অধিকার পুরুষের। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে সচেতনতা বাড়ানো, ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব গড়ে তোলার মতো নানা কার্যক্রম আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা মনে করছি, সমাজ এখন কিছুটা হলেও পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার শেহেরীন আলম সারাবাংলাকে বলেন, পরিবারে মা-বাবা তো বটেই, স্কুলের শিক্ষকদেরও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ছেলে-মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই সমঅধিকার সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। ছেলে-মেয়েদের একটি বৈষম্যহীন পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। পরিবার এগিয়ে এলে সেটি খুবই সম্ভব।
সারাবাংলা/আইই