Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘উচিৎ শিক্ষা’ দিতে খুনের পর মাংস-হাড় কেটে ছড়িয়ে দেন সহকর্মীরা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:২০

শিবলী সাদিক, ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের রাউজানে কলেজ ছাত্রকে খুনের পর লাশ গুমের উদ্দেশে মাংসখণ্ড ও হাড়গোড় আলাদা করে পাহাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার ঘটনায় আরও দু’জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এ নিয়ে পুলিশ ও র‌্যাব মিলে ঘটনায় জড়িত সাতজনকে গ্রেফতারের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে।

রোববার (১ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের প্রধান লেফট্যানেন্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম জানিয়েছেন, খুনের শিকার কলেজ ছাত্র শিবলি সাদিককে অপহরণ ও হত্যায় জড়িত পাঁচ যুবক রাউজানে একই মুরগির খামারে চাকরি করতেন। কর্মস্থলে দ্বন্দ্বের জেরে তাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে পাঁচ সহকর্মীর পরিকল্পনায় অপহরণ করে পাহাড়ের একটি অপরাধী চক্রকে দিয়ে খুন করে। এরপর লাশ গুমের উদ্দেশে মাংসখণ্ড ও হাড়গোড় আলাদা করে পাহাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখে।

গত ২৮ আগস্ট রাতে রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়া গ্রাম থেকে অপহরণের শিকার হয় শিবলী সাদিক হৃদয় (২০)। কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র শিবলী পড়ালেখার পাশাপাশি একই গ্রামের সিকদার পাড়ায় মুরগির খামারে চাকরি করত।

অপহরণের ১৪ দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার বালুখালী পাহাড় থেকে মাটি খনন করে শিবলীর কঙ্কাল উদ্ধার করে রাউজান থানা পুলিশ। এর আগের রাতে পুলিশ নগরীর চান্দগাঁও থেকে ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন— রাঙ্গামাটি জেলার উমং চিং মারমা (২৬), সুইংচিং মং মারমা (২৪), অংথইমং মারমা (২৫), আছুমং মারমা (২৬) এবং উক্য থোয়াইং মারমা (১৯)।

তাদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে শিবলীর কঙ্কাল উদ্ধার করে গ্রামে ফেরার পর উত্তেজিত জনতা পুলিশের কাছ থেকে উমং চিং মারমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে। গ্রেফতার সাতজনের মধ্যে সুইচিং মং মারমা ও অংথুইমং মারমা আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

এরপর শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাতে র‌্যাবের একটি দল নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও শাহ আমানত সেতু এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরও দু’জনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন— রাঙ্গামাটির উচিংথোয়াই মারমা (২৩) ও বান্দরবানের ক্যাসাই অং চৌধুরী (৩৬)।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই আসামির জবানবন্দিতে উচিংথোয়াই ও ক্যাসাইয়ের নাম এসেছে। আমরা তাদের অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি।’

দুই আসামির জবানবন্দি এবং সর্বশেষ গ্রেফতার দু’জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শিবলী সাদিককে অপহরণের পর হত্যার লৌমহর্ষক বর্ণনার পাশাপাশি নেপথ্যের রহস্যও উদঘাটন হয়েছে।

চট্টগ্রাম জোনের সদর ক্যাম্প কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের সিকদার পাড়ায় একই মালিকের দুটি মুরগির খামারের ব্যবস্থাপক ছিলেন শিবলী সাদিক। খামারে কর্মচারী ছিলেন গণপিটুনিতে নিহত উমং চিং মারমাসহ পাঁচজন। মুরগিকে খাবার কম দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিবলীর সঙ্গে তাদের বিরোধ তৈরি হয়। কয়েকদফা ঝগড়ায়ও জড়ান তারা। খামারের মালিক তাদের মধ্যে মিমাংসা করে দেন।

‘কিন্তু পাঁচ কর্মচারী শিবলীকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন। খামারে চাকরি না করলেও বিভিন্নসময় তাদের কাছে আসতেন উচিংথোয়াই। সে পাহাড়ে অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। কর্মচারীরা তাকে বিষয়টি জানালে উচিংথোয়াই শিবলীকে তুলে নিয়ে খুনের কথা বলেন। সে অনুযায়ী, ২৮ আগস্ট শিবলীকে পাঁচ কর্মচারী মিলে জোরপূর্বক একটি অটোরিকশায় তুলে মুখে গামছা বেঁধে পাশের উপজেলার রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ে একটি সেগুন বাগানে নিয়ে জিম্মি করে রাখে।’

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব কর্মকর্তা মাহফুজুর আরও বলেন, ‘সেখানে একদিন জিম্মি রাখার পর উমংচিং (গণপিটুনিতে নিহত কর্মচারী) তাকে খুনের সিদ্ধান্ত দেন। হত্যা করার জন্য উচিংথোয়াই মারমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৯ আগস্ট উচিংথোয়াই নিজ হাতে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করে শিবলীর শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে। ক্যাসাইসহ আরও কমপক্ষে ৮-৯ জন মিলে এসময় তার হাত-পা ও মুখ চেপে ধরে রেখেছিল। খুনের পর লাশ প্রথমে পাহাড়ের চূড়ায় কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখে।’

‘এভাবে লাশ রেখে দিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটা উদ্ধার করতে পারবে, এ আশঙ্কায় তারা গুমের সিদ্ধান্ত নেয়। উচিংথোয়াই মূলত মাংসখণ্ড কেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার নৃশংস সিদ্ধান্তের কথা জানায়। সে অনুযায়ী, তারা লাশের শরীর থেকে মাংস কেটে আলাদা করে ফেলে দেয় এবং হাড়গোড় আরও কয়েকটি পাহাড়ের পর আরেকটি গহীন পাহাড়ের জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে চলে আসে।’

অপহরণ ও হত্যা এবং লাশ ‍গুমের ঘটনায় খামারের পাঁচ কর্মচারীর পাশাপাশি উচিংথোয়াইয়ের নেতৃত্বে পাঁচ থেকে ছয় সদস্যের আরও একটি অপরাধী চক্র অংশ নেয় বলে জানান মাহফুজুর রহমান।

এদিকে শিবলীকে ‍খুনের পরও তার বাবার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয় বলে জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘শিবলীকে খুনের পর পাঁচ কর্মচারী যথারীতি খামারে এসে কাজে যোগ দেয়। নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজতে তার বাবা যান খামারে। এসময় উমংচিং তার বাবাকে নিয়ে বান্দরবানে এক কথিত গণক ঠাকুরের কাছে গিয়ে শিবলীকে খুঁজে দেওয়ার অভিনয় করেন। তবে এর আগেই তাকে খুন করা হয়।’

‘২৮ আগস্ট শিবলীকে জিম্মি করে রাখার একপর্যায়ে তার মোবাইলের সিম থেকে তার বাবার কাছে ফোন করে উচিংথোয়াই ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। বাবা টাকা দিতে রাজি হন এবং কিছু সময় চান। এরপরও ২৯ আগস্ট শিবলীকে খুন করা হয়। খুনের পর আবারও উচিংথোয়াই তার বাবাকে ফোন করে টাকার জন্য চাপ দেন। ১ সেপ্টেম্বর বাবা ও নানা মিলে বান্দরবানে গিয়ে তার হাতে দুই লাখ টাকা দেন। তখন উচিংথোয়াই জানান যে, শিবলীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সে যথাসময়ে বাসায় ফিরে যাবে।’

মুক্তিপণের দুই লাখ টাকা থেকে উচিংথোয়াই দেড় লাখ এবং বাকিদের ৫০ হাজার টাকা ভাগ করে দেওয়া হয় বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান।

সারাবাংলা/আরডি/এনএস

চট্টগ্রাম টপ নিউজ শিবলী সাদিক


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর