পৌরসভার মার্কেটের ‘বলি’ লালদিঘি এখন ধুঁকছে
২ অক্টোবর ২০২৩ ১১:১৬ | আপডেট: ২ অক্টোবর ২০২৩ ১১:১৭
এক পাশে গড়ে উঠছে পৌরসভার হেরিটেজ মার্কেট (বাঁয়ে), আরেক পাশে রাজু মঞ্চ। এভাবেই দখল হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী লালদিঘির অনেকটাই। ছবি: সারাবাংলা
যশোর: প্রায় ২০০ বছরের লালদিঘি। যশোর পৌর শহরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বহু মানুষের নিত্যদিনের নানা কাজের প্রয়োজন মেটায়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্জন ছাড়াও সূর্যপূজাও হতো সেই দিঘিতে। শহরের কোথাও আগুন লাগলেও পানির সবচেয়ে বড় উৎসেই ছিল লালদিঘি। পৌরসভারই বাণিজ্যিক উদ্যোগের জায়গা করে দিতে সেই দিঘিই আজ হারিয়েছে তার যৌবন।
শহরবাসীর অভিযোগ, দিঘির অন্তত ৩০ শতাংশ হয়ে গেছে ভরাট, দখল হয়েছে আরও কিছু অংশ। তারা আপত্তি তুললেও শহরের দায়িত্বে থাকা পৌরসভা সে আপত্তিতে কর্ণপাত করেনি। এতে দিঘিটি নান্দনিকতা, সৌন্দর্য, আয়তন সবই হারিয়েছে। এই দিঘিতে এখন দুর্গাপূজায় প্রতিমা বিসর্জনও সম্ভব হবে না।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় ২০০ বছর আগে যশোর শহরের গাড়িখানা সড়কের পাশে পৌরসভার উদ্যোগে এক একর ১২ শতাংশ জমিতে ওই দিঘি খনন করা হয়। এরপর থেকে দিঘিটি যশোর পৌর শহরের সব ধরনের মানুষের নানা কাজের অংশ হিসেবে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিল। কয়েক বছর আগেই দিঘিটি ভরাট করে পৌর কর্তৃপক্ষ মার্কেট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নাগরিকদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও চাপের মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। তবে ২০১৯ সালে আর পৌরসভাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি।
পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের শেষ ভাগে তৎকালীন পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার পৌরসভার উদ্যোগে ১০ তলা পৌর হেরিটেজ ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য ২০২০ সালে লালদিঘির উত্তর দিকের অনেকটা অংশ ঘিরে ফেলা হয়। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ওই সময় জানায়, ভবনের দুটি পিলার স্থাপন করা হবে দিঘির মধ্যে, যা খুব বেশি জায়গা নেবে না।
ওই ভবনের পাইলিং শেষে বেজমেন্টসহ মূল কাঠামোর অনেকাংশ এখন দৃশ্যমান। তাতে দেখা যায়, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ দুটি পিলারের কথা বললেও দিঘিতে স্থাপিত হয়েছে ছয়টি পিলার। মূল ভবনের দেয়ালের একটি অংশও পানিতে ডুবে আছে। এর ফলে দিঘির ওই পাশে ৩০ শতাংশ ভরাট করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সৌন্দর্যবর্ধনের নামে দিঘির আরেক পাশে রাজু মঞ্চ তৈরি করে দিঘিকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই যশোর পৌরসভার।

হেরিটেজ মার্কেটের দুটি পিলার লালদিঘিতে স্থাপনের কথা থাকলেও পিলার বসানো হয়েছে ছয়টি, মার্কেটের দেয়ালের একাংশও রয়েছে দিঘিতে। তাতে দখল হয়েছে দিঘির প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা। ছবি: সারাবাংলা
লালদিঘি বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সদস্য ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, খোদ পৌর কর্তৃপক্ষ ঐতিহ্যবাহী লালদিঘি ভরাট করছে। অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না। পৌরসভা যেভাবে দিঘিটি ভরাট করেছে, তাতে একে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আকার-আয়তনে এটি অনেক ছোট হয়ে গেছে। কোথাও আগুন লাগলে আর এখান থেকে তেমন পানি পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকছে না।
মাহমুদ হাসান আরও বলেন, সাধারণ নাগরিক এবং আমরা যারা এ নিয়ে প্রতিবাদমুখর হয়েছিলাম, তাদের উন্নয়নবিরোধী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া রাজু মঞ্চের নামেও দিঘিটি সংকুচিত করা হয়েছে। যশোর আওয়ামী লীগের সাবেক ওই নেতার নামে মঞ্চ করতে দিঘি সংকুচিত করার কোনো দরকার ছিল না। পাশেই করা যেত। কর্তৃপক্ষ পরিবেশ ও মানুষের স্বস্তির কথা না ভেবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণে বেশি আগ্রহী। লালদিঘিসহ শহরের সব পুকুর-দিঘি ভরাট হয়ে গেলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে।
সম্প্রতি লালদিঘি ভরাট হয়ে যাওয়া নিয়ে সমালোচনা করেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যও। এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পৌরসভার উদ্যোগে হেরিটেজ মার্কেট করতে গিয়ে লালদিঘির অনেকাংশ দখল হয়ে গেছে। এখন আর লালদিঘিতে প্রতিমা নিরঞ্জন বা বিসর্জন হবে না। নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে ঘাট করে দেওয়া হয়েছে, এ বছরের দুর্গাপূজায় সেখানে প্রতিমা নিরঞ্জন হবে।
এ পরিস্থিতিতে লালদিঘি যতটুকু রয়েছে, ততটুকুই রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সুন্দর করে রাখার তাগিদ দিচ্ছেন লালদিঘি বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সদস্য মাহমুদ হাসান। তিনি বলেন, দিঘির বাকি অংশকেও অনেকে আবর্জনার স্তূপ বানিয়ে ফেলছেন। কিন্তু এই অংশটুকু অন্তত সুন্দর করে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের আঙিনার পুকুরটি সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি ব্যবহারোপযোগী করা হয়েছে। সেখানে পানির রিজার্ভও ঠিক রয়েছে। লালদিঘির অবশিষ্ট অংশও একইভাবে সংরক্ষণ করা জরুরি।
এদিকে ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা শহরের লালদিঘি ভরাট করে ভবন নির্মাণ আইনবিরুদ্ধ উল্লেখ করে তা অপসারণের জন্যে তিন মন্ত্রণালয়ের সচিব, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও যশোর পৌর কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছিল। ওই সময় মেয়র জহিরুল বলেছিলেন, দিঘির পাড়ে ৩৫ শতক জমিতে ১০ তলা হেরিটেজ মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে পাইলিংয়ের জন্য বালি ফেলা হয়েছে। নির্মাণ ওই বালি আবার তুলে ফেলা হবে। লালদিঘি ভরাট করা হবে না।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেয়রের সে কথা সত্যি হয়নি। তিন বছর যশোর পৌরসভার মেয়র হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার গণি খান পলাশ। তার আমলে নতুন করে ভরাট না হলেও লালদিঘির আগের দখল হয়ে যাওয়া অবস্থাই বহাল রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পৌর হেরিটেজ মার্কেটেটির দ্বিতীয় তলার নির্মাণ শেষে আপাতত তৃতীয় তলার কাজ এখন বন্ধ রয়েছে।

পৌরসভার বাসিন্দারা বলছেন, রাজু মঞ্চটি পুকুরের মধ্যে না করে পুকুরের পাড়ে করলে পুকুরের এই অংশটুকু দখলমুক্ত থাকত। ছবি: সারাবাংলা
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, আমরা আদালতের মাধ্যমে নোটিশ দিয়েছিলাম। ওই সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ভরাট হবে না, লালদিঘিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু তারপর যা হয়েছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছে। এখন যেটুকু আছে তার যথাযথ ব্যাবহার ও সংরক্ষণ দরকার।
এই আইনজীবী জানান, জলাশয় সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী স্বীকৃত কোনো জলাশয় কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। তারপরও এগুলো চলছেই। এখন লালদিঘির পাশে ওয়াকওয়ে তৈরি করা, সৌন্দর্যবর্ধন ও ব্যবহারোপোযোগী করা, পানির রিজার্ভ ঠিক রাখা, যথাযথ যত্ন নেয়া, পরিছন্ন রাখা পৌরসভার দায়িত্ব। পৌরসভা চাইলে এসব কাজে সবাই সহযোগিতা করবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে যশোরের পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার গণি খান পলাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘লালদিঘি ভরাট নিয়ে আদালতের কোনো নোটিশ বা চিঠি পাইনি। তবে দিঘি ভরাট করাও হচ্ছে না।’
পিলার দিয়ে ভবন যতটুকু দাঁড় করানো হয়েছে তাতে দিঘির ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেন মেয়র। বলেন, বর্তমানে দিঘির সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। শিগগিরই টেন্ডার হবে। তবে এ বছর এই দিঘিতে প্রতিমা বিসর্জন হবে কি না, বলতে পারছি না। কারণ প্রতিমা নিরঞ্জন করতে যতটা জায়গা লাগে দিঘিটি তার চেয়ে ছোট অবস্থায় রয়েছে।
সারাবাংলা/টিআর