খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সফল কৃষি নীতি
৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:১০
আঠারো শতকের বাংলা ছিল একটি সমৃদ্ধি ও সুখের দেশ। সেই স্বর্ণযুগের বাংলাদেশ ছিল কৃষি প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। দেশটি তখন কৃষি উৎপাদনের জন্য সারা বিশ্বে বিখ্যাত ছিল। মসলিন কাপড়, রেশম, তুলা, মশলা ইত্যাদি রফতানি করত বলে এদেশ তখন অনেক বিদেশি ব্যবসায়ীকে আকর্ষণ করেছিল। অষ্টাদশ শতকে বাংলা ছিল তৎকালীন সময়ের একটি লোভনীয় বাণিজ্যকেন্দ্র। সেসময়ের বাংলাকে জীবনমানের দিক থেকে গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে তুলনা করা হত।
পরাধীনতার যাঁতাকলে বাংলার জৌলুশ যখন অস্তমিত, সমৃদ্ধির দেশ যখন খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে নিমজ্জিত, দুর্ভিক্ষ ও দরিদ্রতা যখন জেঁকে বসেছিল বাংলায়, এ মাটিতে তখন আবির্ভাব হয় এক কালজয়ী নেতার— তিনি হলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। বাংলার গৌরবময় অতীতকে পুনরুদ্ধার করার চিন্তায় সর্বদা বিভোর থাকতেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন টেকসই কৃষি উৎপাদন অর্জনের মাধ্যমে বাংলার স্বর্ণযুগের গৌরবকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থনৈতিক সংকট ছিল প্রকট। সকল ধরনের মৌলিক চাহিদা, বিশেষ করে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রচুর। সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশটিতে তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৫-৩০ লাখ মেট্রিক টন। স্বাধীন দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পরই বঙ্গবন্ধু কৃষিখাতে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল খাদ্যে বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। নয় মাসের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে কৃষকরা মাঠে ফসল ফলাতে সমস্যায় পড়েন। যুদ্ধের সময় অনেক কৃষককে বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়েছিল, ফলে অনেকেই জমি চাষ করতে পারেনি। এছাড়া ফসল ফলানোর জন্য কোনো বীজ, সার ও কীটনাশক ছিল না। সেচ সুবিধার ঘাটতিও ছিল প্রকট। বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন, দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি কৃষিক্ষেত্রের উন্নতির জন্য ১৯৭২ সালে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন এবং বালার জনগণকে বেশি বেশি ফসল ফলানোর তাগিদ দেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেই কৃষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের প্রথম আর্থিক বাজেটে, মোট ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ১০১ কোটি টাকাই তিনি বরাদ্দ করেন কৃষি খাতে। তার সরকার স্লোগানটিকে কেবল স্লোগান হিসেবেই ব্যবহার করেনি; বরং ২২ লাখের বেশি গৃহহীন কৃষক পরিবারকে অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে পুনর্বাসন করেছিল। তিনি দেশের ভূমিহীন কৃষকদের খাস জমি বিতরণের ব্যবস্থাও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একটি কার্যকরী সমীক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ছাড়া কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়ন সফল হবে না। যথাযথ পরিকল্পনার জন্য এটি অপরিহার্য ছিল। এ জরিপের ভিত্তিতে তিনি কৃষিক্ষেত্রের সার্বিক উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন।
শিক্ষিত জনগণকে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা ছিল প্রবল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় তিনি মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি শিক্ষা গ্রহণের উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন, যেন তারা বাংলার কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদের জন্য প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি তার বক্তৃতায় কৃষি গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন, ‘কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য শুধু বই পড়াই যথেষ্ট নয়। প্রত্যেক কৃষিবিদকে গ্রামে যেতে হবে এবং কৃষকদের সাথে থেকে কাজ করতে হবে। বাংলার কৃষকদের কৃষি বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।’
১৯৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছরে বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতি কোনো সরকারই মেটাতে সক্ষম হয়নি। এরপর বাংলার ভাগ্যাকাশে আবারও একটি গৌরবময় অধ্যায় লিখিত হয় ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে। যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পরপরই পিতার অংকিত পরিকল্পনাকে হৃদয়ে ধারণ করে তারই দেখানো পথ ধরে বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লবের পূণর্জাগরণ করেন। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।
সেই প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে গৌরবময় সাফল্য অর্জন করেছিল। মাত্র পাঁচ বছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৯৯৫ সালে খালেদা জিয়া সরকারের ২,৯০৮ মেগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০১ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ৪,৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছিল, যা সরাসরি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ অভূতপূর্ব কৃষি প্রবৃদ্ধি দেখেছিল। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি শাসনামলে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকেনি। খালেদা জিয়ার সরকার জনগণের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয় এবং সার, বীজ, ডিজেল প্রভৃতি কৃষি উপকরণ সংগ্রহ ও বিতরণে মারাত্মক অব্যবস্থাপনা করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে আসে। এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে খাদ্যে স্বনির্ভর একটি দেশ আবারও খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত হয়।
এ অবস্থায় শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি খাদ্যের মূল্য গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং ২০১২ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার অঙ্গীকার নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২০০৭-০৮ এর খাদ্য সংকটের ধাক্কা এবং ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতিকে কাটিয়ে উঠে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে শেখ হাসিনার সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। তার সরকার সার, মানসম্মত বীজ, ডিজেলসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের উপর ভর্তুকি বৃদ্ধি করাসহ সহজ শর্তে কৃষকদের মাঝে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করে। এভাবে, ২০০৯ সালের শেষ নাগাদ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ৩.৫ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশে ফিরে আসে।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার ক্রমাগত সরকার কৃষি খাতে একটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে যা একটি উল্লেখযোগ্য স্তরে দারিদ্র বিমোচন করেছে এবং বাংলাদেশ থেকে মঙ্গা দূরীভূত হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার দেশের শতভাগ জনসংখ্যাকে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে এসেছে। যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থাপনার অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩২.৯০ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭.৭৭ টনে উন্নীত হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির ফলস্বরূপ বাংলাদেশ এখন পাট রফতানিতে প্রথম, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, হেক্টর প্রতি ফলের ফলন বৃদ্ধিতে প্রথম, শস্যের জাত উন্নয়নে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাল ও চা উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা ও আলু উৎপাদনে চতুর্থ এবং মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ। ভূমির আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ ৯৪তম হলেও প্রাথমিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ১৪তম স্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে চাল, মসুর, আলু, পেঁয়াজ, চা এবং বিভিন্ন ফলসহ ২২টি কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে ১০টি শীর্ষ দেশের মধ্যে রয়েছে। বর্তমান সরকারের কার্যকর কর্মসূচির ফলে বাংলাদেশের ৪০০০ বিলিয়ন টাকা মূল্যের ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন উল্লেখযোগ্য কৃষি উৎপাদন বৈশ্বিক কৃষি বাজারে দেশের কৃষি দক্ষতা ও গুরুত্বকে তুলে ধরে।
লেখক: চেয়ারম্যান, সার্জারি ও থেরিওজেনোলজি বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/আইই