Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইসরাইলে গুপ্ত হামলা: হামাসের কে এই দেইফ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১১ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৪৩

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস গত শনিবার (৭ অক্টোবর) ইসরাইলে আকস্মিক রকেট হামলায় চালায়। ২০ মিনিটে প্রায় ৫ হাজারের অধিক রকেট নিক্ষেপ করে হামাস। এই বিধ্বংসী হামলাকে  ৯/১১ মুহূর্ত বলে অভিহিত করেছে ইসরাইল। পরে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেশটি। ১৯৭৩ সালে আরব দেশগুলোর সঙ্গে যুদ্ধের পর এমন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়নি ইসরাইল। এই আক্রমণে অবাক হয়েছে পুরো বিশ্ব। হামাসের এই ধ্বংসাত্মক হামলার পেছেন মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উঠে এসেছে মোহাম্মদ দেইফ’র নাম। এবারের হামলাকে ‘আল-আকসার বন্যা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গত শনিবার রকেট হামলার সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রচারিত একটি অডিও রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। সেই বার্তায় ইসরাইলের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় থাকা এই হামাস নেতা বলেন, জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি হামলার জবাবে এই হামলা।

২০২১ সালের মে মাসে ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থানে ইসরাইলের সেনবাহিনী একটি অভিযান চালায়। যা আরব এবং মুসলিম বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করে। এরপর থেকেই দেইফ এই অপারেশনের পরিকল্পনা শুরু করেন বলে হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়। টানা চার দিনের এই যুদ্ধে হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ ইসরাইলি নিহত ও ২ হাজার ৪০০ জন আহত হয়েছেন। এদিকে ইসরাইলের বিমান হামলায় ১ হাজার ৫৫ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৫ হাজার ১৮৪ জন আহত হয়েছেন।

‘গত রমজানে আল-আকসা মসজিদে ইজরাইলের হামলা, নামাজিদের মারধর, তাদের আক্রমণ, বয়স্ক ও যুবকদের মসজিদ থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এই সব ক্রোধকে জ্বালিয়েছে’— সূত্র জানায়। ওই ঘটনার দুই বছরেরও বেশি সময় পর গত শনিবার এই হামলা চালায় হামাস।

২০২১ সালে’সহ সাতবার ইসরায়েল হত্যার চেষ্টা করলেও বেঁচে যান দেইফ। খুব কমই কথা বলেন এবং জনসমক্ষে কখনো উপস্থিত হন না তিনি। তাই হামাসের টিভি চ্যানেল যখন ঘোষণা করে যে, শনিবার তিনি বক্তৃতা করবেন, ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পেরেছিল উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

ওই অডিও বক্তব্যে দেইফের মাত্র তিনটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। এরমধ্যে একটি তার ২০ এর দশকের, অন্যটি তার মুখোশ পরা এবং অপরটি তার ছায়ার একটি চিত্র।

দেইফের অবস্থান অজানা। তবে ধারণা করা হয় তিনি সম্ভবত গাজায় মাটির নিচে কোনো সুড়ঙ্গের থাকেন। ইসরাইলের একটি নিরাপত্তা সূত্র জানায়, দেইফ হামলার পরিকল্পনা ও পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

বিজ্ঞাপন

সিদ্ধান্ত দুই ব্যক্তির, পরিকল্পনাকারী একজন

ফিলিস্তিনি সূত্র জানায়, একরাতে গাজায় বিমান হামলা চলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। সেই হামলায় একটি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে যায়, যা দেইফের বাবার। হামলা তার ভাইসহ পরিবারের অন্য দুই সদস্য নিহত হন।

হামাসের ঘনিষ্ঠ সূত্রটি বলেছে, হামলার সিদ্ধান্ত যৌথভাবে গৃহীত হয়েছিল। হামাসের আল কাসাম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ও গাজার হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার এই সিদ্ধান্ত নেন। তবে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ব্যক্তি কে তা পরিষ্কার ছিল।

সূত্রটি বলেছে, ইসরাইলে হামলার পরিকল্পনার পেছেনে ‘দুইজন আছেন, কিন্তু মাস্টারমাইন্ড (মূল পরিকল্পনাকারী) একজন।’ কেবলমাত্র হামাসের হাতেগোনা কয়েকজন নেতাই এই অভিযানের কথা জানতেন।

হামাসের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে পরিচিত ওই সূত্র জানায়, গোপনীয়তা এমন ছিল যে, ইসরাইলের চিরশত্রু এবং হামাসের প্রধান অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসের দেশ ইরানও এই পরিকল্পনার বিষয়ে তেমন কিছু জানত না। কেবলমাত্র সাধারণভাবে জানত, হামাস একটি বড় অপারেশনের পরিকল্পনা করছে।

সূত্র জানায়, তেহরান যখন বুঝতে পারে একটি বড় অপারেশনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তখন হামাস, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব, ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সঙ্গে জড়িত কোনো যৌথ অপারেশনের রুমে এটি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। এটি ‘খুবই নির্দিষ্ট একটি গ্রুপ ছিল।’

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি গতকাল মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) বলেছেন, ইসরাইলের ওপর হামলার সঙ্গে তেহরান জড়িত নয়। তেহরান জড়িত থাকার বিষয়ে ওয়াশিংটন জানায়, তাদের কাছে কোনো গোয়েন্দা তথ্য বা প্রমাণ নেই, যা এই হামলায় ইরানের সরাসরি অংশগ্রহণকে নির্দেশ করে।

দেইফের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে ছলনার আশ্রয় নেওয়া হয়। ইসরাইলকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে, হামাস এখন আর সংঘাতে জড়াতে আগ্রহী নয়। বরং গাজার ক্ষমতাসীন দলটি স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশি মনোযোগী।

হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, যখন ইসরাইল গাজার কর্মীদের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে, তখন হামাসের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন করানো হচ্ছিল, যে দৃশ্য প্রায়ই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দেখে থাকে।

হামাসের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান আলি বারাকা বলেছেন, ‘আমরা এই যুদ্ধের জন্য দুই বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি।’

পূর্বে রেকর্ড করা ওই অডিও বার্তায় দেইফ শান্ত কণ্ঠে বলেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অপরাধ বন্ধ করার জন্য, বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য- যাদের নির্যাতিত ও নির্যাতন করা হয়েছিল এবং ফিলিস্তিনি জমির দখল বন্ধ করার জন্য ইসরাইলকে বারবার সতর্ক করেছিল হামাস।

কিন্তু ইসরাইল ‘প্রতিদিন পশ্চিম তীরের আমাদের গ্রাম, শহর ও শহরে আক্রমণ করে এবং বাড়িঘরে হামলা চালায়, হত্যা করে, আহত করে, ধ্বংস করে এবং আটক করে। একই সময়ে, এটি আমাদের হাজার হাজার একর জমি বাজেয়াপ্ত করে, আমাদের লোকদের তাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়। গাজায় তাদের অবৈধ অবরোধ অব্যাহত থাকার সময় বসতি স্থাপন করে।’

‘আড়ালের মানুষ’

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিম তীরে অশান্তি বিরাজ করছে। প্রায় ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৫০ কিলোমিটার প্রশস্ত এলাকাটি ইসরাইলি-ফিলিস্তিন সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। যা ১৯৬৭ সালে দখল করে ইসরাইল।

দেইফ বলেন, হামাস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘দখলদারি অপরাধ’ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ইসরাইল তার উস্কানি বাড়িয়েছে। হামাস অতীতে ইসরাইলকে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দিতে মানবিক চুক্তি করতে বলেছিল, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, ‘দখলদারিত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইন ও সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করা, আমেরিকান ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক নীরবতার কারণে, আমরা এসব কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর স্থাপিত খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে ১৯৬৫ সালে মোহাম্মদ মাসরি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া প্রথম ইন্তিফাদা বা ফিলিস্তিনি বিদ্রোহের সময় হামাসে যোগদানের পর তিনি মোহাম্মদ দেইফ নামে পরিচিত হন।

হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, ১৯৮৯ সালে তাকে গ্রেফতার করেছিল ইসরাইল এবং প্রায় ১৬ মাস আটকে রাখা হয়েছিল।

দেইফ গাজার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং জীববিদ্যায় পড়াশোনা করেন তিনি। শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ ছিল তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদন কমিটির প্রধান ছিলেন এবং মঞ্চে কমেডিতে অভিনয় করেছিলেন হামাসের এই শীর্ষ নেতা।

হামাসের টানেলের নেটওয়ার্ক এবং বোমা তৈরির দক্ষতা তৈরি করে সংগঠনটির নেতৃত্ব সারিতে উঠে আসেন মোহাম্মদ দেইফ। মৃত্যু দেইফের জীবনে ছায়ায় মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হামাস সূত্র জানায়, ইসরাইলের এক হত্যা প্রচেষ্টায় একটি চোখ হারিয়েছিলেন তিনি এবং একটি পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।

২০১৪ সালে ইসরাইলি বিমান হামলায় দেইফের স্ত্রী, ৭ মাস বয়সী ছেলে এবং ৩ বছরের মেয়ে নিহত হয়। হামাসের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, হামাসের সশস্ত্র শাখা চালানোর সময় দেইফের বেঁচে থাকা তাকে ফিলিস্তিনি জননেতার মর্যাদা দিয়েছে।

দেইফের ভিডিওগুলোতে তাকে মুখোশ পরে থাকেন, বা তার একটি ছায়া দেখা যায়। তিনি স্মার্ট ফোনের মতো আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না।

‘তিনি অধরা। তিনি আড়ালের মানুষ।’

সারাবাংলার পাঠকদের জন্য রয়টার্স’র প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন নিউজরুম এডিটর নূর সুমন

সারাবাংলা/এনএস

ইসরাইল মোহাম্মদ দেইফ হামাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর