বিএনপি ছেড়ে আসা ভিপি নাজিমের কণ্ঠে ‘আ.লীগের সুর’
১৫ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৫৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: নতুন রাজনৈতিক দল ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম’র আত্মপ্রকাশের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন বিএনপি ছেড়ে আসা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সাবেক ভিপি নাজিম উদ্দিন। প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যেসব বক্তব্য এসেছে, সেগুলো অনেকটাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের মতোই।
রোববার (১৫ অক্টোবর) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলটির আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে, একমাসের মধ্যে ঢাকায় কনভেনশন করে দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে, যাতে বড়ধরনের চমক থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরামের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। চাকসু ভিপি নাজিম উদ্দিন আহ্বায়ক, জিএস আজিম উদ্দিন সদস্য সচিব এবং ফেরদৌস বশীর, সোহেল রহমান ও সিরাজুল ইসলামকে সদস্য ঘোষণা করা হয়েছে। মঞ্চে উপস্থিত পাঁচ নেতাই নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান দলের সদস্য সচিব চাকসু’র জিএস আজিম উদ্দিন। এতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়, দেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একটা অনিশ্চিত অভিযাত্রায় জাতি আজ দু’ভাগে বিভক্ত। কেউ পরিষ্কার জানে না কি হতে চলছে। নির্বাচন হবে কি না, বিরোধীদল নির্বাচনে অংশ নেবে কি না ? দেশের অর্থনীতি সচল থাকবে কি না? মেগা প্রজেক্টগুলো অব্যাহত থাকবে কি না ? দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার কঠোর হবে কি না? নানা প্রশ্ন জনগণের মনে উঁকি দিচ্ছে। চরম এক অনিশ্চতায় দেশের জনগণ।’
আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতার প্রসঙ্গে বলা হয়, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দেশি-বিদেশি নানা গ্রুপ-গোষ্ঠী তৎপর হয়ে উঠছে। নানা এজেন্ডা নিয়ে প্রত্যেকেই যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে তৎপর! পশ্চিমা বিশ্ব- আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ ক্রমাগত চাপ তৈরি করে চলেছে স্যাংশনের ভয় দেখিয়ে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির করে দিয়ে।
সংবাদ সম্মেলনে নেতারা বলেন, আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটা দেশের জনগণই ঠিক করতে পারে, বিদেশিরা নয়। আমরা মনে করি, বিদেশিদের এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে রয়েছে তাদের স্বার্থ ও ভৌগোলিক আধিপত্য বিস্তারের নীলনকশা।
আরও পড়ুন: বিএনপি ছাড়লেন ভিপি নাজিম উদ্দিন, গড়ছেন নতুন দল
সাংঘর্ষিক রাজনীতি পরিহারের আহ্বান জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দেশে কোনো সাংঘর্ষিক রাজনীতি আমরা চাই না। ভাংচুর, গাড়ি পোড়ানো, মানুষ হত্যা, হরতাল-অবরোধ রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। আমরা দেখেছি, অতীতেও সাংঘর্ষিক রাজনীতি দেশের কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একশ্রেণির মানুষ বেশ তৎপর। দেশে-বিদেশে বসে পাল্টাপাল্টি প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। লাগামহীন মিথ্যাচারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে চরম বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা তৈরি করছে।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বিভিন্ন অভিযোগ জনমনে আছে, এমন বক্তব্য উল্লেখ করে একই সময়ে রাজনীতিতে নেতিবাচক পরিবর্তনের কথাও তুলে ধরা হয়। তারা বলেন, এখন আর রাজনীতিতে ভালো লোকের স্থান নেই। ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবীদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই। জাতীয় সংসদের ৮০ ভাগ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা। প্রকৃত রাজনীতি নির্বাসনে গেছে। সুযোগসন্ধানীরা ক্ষমতা ও অর্থকে ব্রত হিসেবে নিয়েছে। জনতার রাজনীতি প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
তাই উদ্ভূত সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ধারার উন্মেষ সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। তারা আরও বলেন, আমরা সমমনা, দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের সহযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে একটি ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।
আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে নতুন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা দেখছি, দেশে গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। দেশে যেমন সুশাসন দরকার, তেমনি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাও দরকার। এর অনুপস্থিতিতে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতাও থাকে না।
সংবাদ সম্মেলনে এক মাসের মধ্যে ঢাকায় নতুন দলের কনভেনশনের ঘোষণা দিয়ে চাকসু ভিপি নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘কনভেনশন থেকে ১০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা সাবেকমন্ত্রী আরিফ মঈনউদ্দিন সাহেব হবেন আমাদের এক নম্বর সদস্য। তিনি এখন কানাডায় আছেন, তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। আরও অনেকে আমাদের সঙ্গে আছেন। অপেক্ষা করেন, কনভেনশনে অবশ্যই চমক থাকবে, অনেক চমক থাকবে।’
নতুন দলের লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই। গণতান্ত্রিক সুস্থ ধারার লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি আমরা কারও বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই না, অভিযোগ করতে চাই না। সিনিয়র রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা অহেতুক শিষ্টাচারবর্জিত কোনো বক্তব্য-বিবৃতি থেকে আমরা দূরে থাকতে চাই। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মতো আমাদের স্পষ্ট অবস্থান থাকবে। সংবিধানের প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকবে ‘
আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে চাকসুর সাবেক ভিপি নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘একশ’র বেশি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। অনেক আসনে একাধিক প্রার্থীও আমাদের আছে।’
নিবন্ধনহীন রাজনৈতিক দল নিয়ে কীভাবে এগোবেন? জানতে চাইলে আজিম উদ্দিন বলেন, ‘নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করব। যদিও আমরা জেনেছি, এখন নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে নিবন্ধিত দলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে তাদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেব আমরা। বিভিন্ন জোটের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হবে, মহাজোটের সঙ্গেও হতে পারে।’
প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম ‘কিংস পার্টি’ কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিংস পার্টির যুগ এটা না। কিংস পার্টি কখন হয়? যখন দেশে অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসক ক্ষমতায় থাকে, তখন রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কিংস পার্টি গঠন করা হয়। কিন্তু দেশে তো এখন অগণতান্ত্রিকে কেউ শাসনক্ষমতায় নেই। গত ১৫ বছর ধরে দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে, তাহলে কিংস পার্টি কিভাবে আসবে? আমাদের দল অবশ্যই কিংস পার্টি নয়।’
আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে গিয়ে ‘ভালো কিছু’ করার তাগিদ থেকে নতুন দল গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করেন চাকসু’র জিএস আজিম উদ্দিন।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ ও চাকসু’র সাবেক ভিপি মজহারুল হক শাহ দর্শকসারিতে বসা ছিলেন। হলের বাইরে আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরীকে দেখা গেছে। ছাত্রজীবনে তিনিও বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত চাকসু নির্বাচনে তৎকালীন বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে ভিপি পদে জয়ী হয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন। এরপর আর চাকসু নির্বাচন হয়নি। এখনও তার পরিচিতি চাকসু ভিপি হিসেবে। ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পর হাটহাজারী উপজেলার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন।
দলটিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সর্বশেষ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সহ সভাপতি ছিলেন। এরপর গঠিত আহবায়ক কমিটিতে তার ঠাঁই হয়নি। গত প্রায় একবছর ধরে তিনি দলে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিলেন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট থেকে নব্বইয়ে চাকসু’র জিএস নির্বাচিত হওয়া আজিম উদ্দিন ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে কিছুদিন বাসদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে গত তিন দশক ধরে তিনি কোনো সক্রিয় রাজনীতি করতেন না।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম