৬০ জেলায় হচ্ছে ডে কেয়ার, কর্মজীবী মায়েদের স্বস্তি
১৫ অক্টোবর ২০২৩ ২৩:২৯
ঢাকা: পাবনা সদরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আফসানা আখতার। স্বামী স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাকরি করেন। ৮ বছরের সংসার তাদের। একমাত্র সন্তানের বয়স তিন বছর। পরিবারের আর কোনো সদস্য থাকেন না তাদের সঙ্গে। ফলে সন্তানকে নিয়ে হিমশিম খেতে হয় আফসানাকে। স্থায়ী একজন গৃহসহায়িকা রয়েছেন বাসায়। তার কাছেই সন্তানকে রেখে আফসানা বিদ্যালয়ে যান।
আফসানা বলেন, বাচ্চাকে এভাবে বাসায় রেখে স্কুলে গিয়ে কাজে মন বসানো কঠিন। স্কুলেও বাচ্চাকে রাখার ব্যবস্থা নেই। শুনেছি বাচ্চাদের রাখার জন্য ঢাকায় ডে কেয়ার সেন্টার আছে। এরকম জায়গা পেলে বাচ্চাকে নিশ্চিন্তে রেখে স্কুল করতে পারতাম।
সারাদেশে আফসানার মতো লাখ লাখ কর্মজীবী মা রয়েছেন, যাদের পরিবারে বাড়তি কোনো সদস্য নেই বলে সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। তারা না পারেন সন্তানকে সঙ্গে রাখতে, না পারেন সন্তানকে নিশ্চিন্তে কোথাও রেখে যেতে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের কর্মজীবী মায়েদের জন্যই সমাধান হয়ে আসতে পারে ডে কেয়ার সেন্টার তথা শিশুদের জন্য দিবা পরিচর্যা কেন্দ্র, যার সংখ্যা দেশে একদমই অপ্রতুল।
এ পরিস্থিতিতেই কর্মজীবী মায়েদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের ৬০টি জেলায় ৬০টি নতুন ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করবে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই উদ্যোগে ডে কেয়ার সেন্টারগুলোতে জায়গা হবে চার মাস থেকে শুরু করে ছয় বছর বয়সী শিশুদের।
সরকারের আশা, মায়েরা তাদের সন্তানদের এসব ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে কর্মস্থলে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। এরই মধ্যে এর একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই প্রকল্পটি মূল্যায়নের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে। এ উদ্যোগে স্বস্তির কথা জানিয়েছেন কর্মজীবী মায়েরা এবং নারী অধিকার কর্মীরা।
দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় তাদের সম্পৃক্ত করতে না পারলে এবং তাদের সম্ভাবনা ও কর্মদক্ষতাকে কর্মমুখী করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব না বলে মনে সরকার। সে কারণে বিভিন্নভাবে সরকার নারীদের কর্মমুখী করতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশাতেও এখন নারীরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে।
নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, এ অবস্থায় জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ও সার্বিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এরই একটি অংশ হিসেবে এবার দেশের ৬০টি জেলায় ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ১২১ কোটি ৯৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ডে কেয়ার সেন্টারের প্রকল্প প্রস্তাবনাটি নিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হবে। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সিনিয়র সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ৬০টি ডে কেয়ার সেন্টারের মধ্যে ৪০টি স্থাপনের দায়িত্বে থাকবে মহিলাবিষয়ক অধিদফতর, বাকি ২০টি বাস্তবায়ন করবে জাতীয় মহিলা সংস্থা। তবে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্প এলাকাগুলোকে এভাবে বিভক্ত করার যৌক্তিকতা নিয়ে পিইসি সভায় আলোচনা করা হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, কর্মজীবী মায়েদের কথা চিন্তা করেই এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে খুবই প্রয়োজনীয় একটি কাজ হবে। মায়েরা যেন চিন্তামুক্তভাবে বাচ্চাদের রেখে কাজে যেতে পারেন এবং মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা হবে।
সরকার জেলাগুলোতে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে— এ তথ্য জানালে পাবনার সেই স্কুলশিক্ষক আফসানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেরিতে হলেও যে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার জন্যও সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করব, ডে কেয়ার সেন্টারগুলো দ্রুত স্থাপন করা হবে। সেখানকার পরিবেশ এবং বাচ্চাদের দেখাশোনা করার ব্যবস্থাও যেন উন্নত হয়। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, এটি আমাদের মতো মায়েদের জন্য অনেক কাজে আসবে। সম্ভব হলে এরকম ডে কেয়ার সেন্টার উপজেলাগুলোতেও তৈরি করা হোক।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে ৬০টি ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগটি খুব ভালো। নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবির সঙ্গে এটি সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে। আমরা আশা করব সেন্টারগুলো আইন অনুযায়ী সুন্দরভাবে পরিচালনা করা হবে, যেন আমাদের মেয়েদের কাজ করার পরিবেশটা সহায়ক হয়।’
প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী একেকটি ডে কেয়ারে ৫০ থেকে ৮০টি শিশু রাখার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। তবে এই সংখ্যাকে পর্যাপ্ত মনে করছেন না ফওজিয়া মোসলেম। তিনি বলেন, ‘তারপরও সরকারি এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আশা করি, এখন সরকারি এসব ডে কেয়ারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও অনেক ডে কেয়ারও গড়ে উঠবে। আর প্রথম উদ্যোগ সরকার নেবে, এটি স্বাভাবিক হলেও আমরা এখানে প্রশিক্ষিত জনবল ও পরিচালনার নিয়মনীতি কঠোরভাবে অনুসরণ দেখতে চাই। ডে কেয়ার সেন্টারগুলো আর পাঁচটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো হলে হবে না।’
কর্মজীবী মায়েদের সুবিধার জন্য সরকারিভাবে ডে কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ অবশ্য অনেক পুরনো। ১৯৯১ সালে প্রথম একটি ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করে সরকার। তবে এরপর আর এ উদ্যোগ গতি পায়নি। এখন পর্যন্ত নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মায়েদের জন্য দুই ধাপে ১২টি ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি ২০টি ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে একনেকে। নতুন ডে কেয়ার সেন্টারের প্রকল্পটি চূড়ান্ত হলে সারাদেশেই সরকারিভাবে কর্মজীবী মায়েরা সন্তানদের রাখার সুযোগ পাবেন।
সারাবাংলা/জেজে/আরএফ/টিআর
কর্মজীবী মা ডে কেয়া ডে কেয়ার ডে কেয়ার সেন্টার নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় শিশু দিবা পরিচর্যা কেন্দ্র