সংকটে জর্জরিত কুবির রসায়ন বিভাগ, ৬ শিক্ষক দিয়ে চলছে ৭টি ব্যাচ
১৮ অক্টোবর ২০২৩ ১১:০৫
কুমিল্লা: শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম সংকট, একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ না করা, সময়মতো ফলাফল প্রকাশ না হওয়া এবং ল্যাবের অপ্রতুলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) রসায়ন বিভাগ। অনার্স ও মাস্টার্সের ২৬৪ শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র ৬ শিক্ষক দিয়ে চলছে ক্লাস-পরীক্ষা, রেজাল্ট প্রস্তুতসহ যাবতীয় কার্যক্রম। নিয়ম না থাকলেও ১৫ শিক্ষকের মধ্যে নয় শিক্ষক রয়েছেন শিক্ষা ছুটিতে। যা মোট শিক্ষকের ৬০ শতাংশ। ফলে স্বল্প সংখ্যক শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নিতে না পারায় শিক্ষা কার্যক্রমের গুণগত মান ব্যাহত হচ্ছে। দেরিতে সেমিস্টার হওয়ায় সেশন জটের কবলে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে, অনিয়মিত ক্লাসের সঙ্গে ক্লাস রুমেরও সংকট থাকায় শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রসায়ন বিভাগের এক সাবেক শিক্ষার্থী জানান, দেরিতে ফল প্রকাশ এবং সিনিয়র শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বলি আমরা। আমাদের বিভাগের শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস রুটিন ফলো করেন না। শিক্ষকদের কাছে কোনো সমস্যার কথা যারাই বলে, তাদেরই একাডেমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা মুখ খুলতে ভয় পায়।
আরেক শিক্ষার্থী জানান, ছয় শিক্ষক দিয়ে সাতটি ব্যাচের ক্লাস নিতে গিয়ে নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা হচ্ছে না। প্রতিটি সেমিস্টারেই দুই থেকে তিন মাস দেরি করে দিতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে আট সেমিস্টারে আমরা দেড় বছর পিছিয়ে যাব। এছাড়াও আমাদের ক্লাসরুম তিনটি। একটি ব্যাচের ক্লাস চলাকালে আরেকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমরা ঠিকমতো পরীক্ষার রেজাল্ট পাই না। এক বর্ষে পরীক্ষা দিলে সেই পরীক্ষার ফল পেতে পেতে আরেক বর্ষ শেষ হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে পদ্ম (ছদ্মনাম) নামের এক শিক্ষার্থী জানান, গত মার্চে দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু সেমিস্টার দেওয়ার আট মাস পার হলেও তৃতীয় সেমিস্টার দিতে পারিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার রয়েছে যেখানে স্পষ্টভাবে প্রতি ছয় মাস অন্তর সেমিস্টার পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা রয়েছে। অথচ আমাদের বিভাগ তা অনুসরণ করছে না। ফলে প্রতিটি সেমিস্টারেই দুই থেকে তিন মাস দেরী হচ্ছে। ফলে অনার্স শেষ করতে হলে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় এক বছরেরও বেশি সময় পিছিয়ে থাকতে হবে।
এ বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক মো. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, আমরা একেকজন শিক্ষক ছয় থেকে সাতটি করে থিওরি কোর্স নিচ্ছি। আমাদের তো ল্যাব ওরিয়েন্টেড ডিপার্টমেন্ট। ল্যাব কোর্স আছে চারটা । একটা সেমিস্টারে ১০টা করে কোর্স একজন শিক্ষকের পক্ষে নেওয়া সম্ভব? আমি চারটা পরীক্ষা কমিটিতে আছি। একেকটা কমিটিতে থাকলে সেখানে কত কাজ। রেজাল্ট মডারেশন , প্রশ্নপত্র কম্পোজ থেকে শুরু করে রেজাল্ট করা, টেব্যুলেশন করা, রেজাল্ট শিট করা কত কাজ।
তিনি বলেন, ৪টা কমিটি মানে মোট কাজের চারগুণ। এছাড়াও মাস্টার্সে দুইজন থিসিস স্টুডেন্ট আছে, ফোর্থ ইয়ারে দুইজন থিসিস স্টুডেন্ট আছে। ওদের সময় দেওয়া, থিসিস করানো, নিজের রিসার্চের কাজ করা। সব মিলিয়ে রোবোটিক স্টাইলে যাচ্ছে জীবনযাপন। আমাদের বিভাগের প্লানিং কমিটি কয়েকবার শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু আসলেই এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান হচ্ছে না।
বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে আমরা ব্যাচগুলো চালাতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের যে ওয়ার্ক লোড আছে, সেখানে একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা ক্লাস নিতে পারবেন। প্রফেসরের ক্ষেত্রে তা ৬ ঘণ্টা। আমি ম্যাক্সিমাম ২টা কোর্স নিতে পারি। বাকি সময়টা আমার রিসার্চ বা প্রজেক্টে সময় দেওয়ার কথা। কিন্তু আমাকে ৬ থেকে ৭টা কোর্স নিতে হচ্ছে। ফলে আমাকে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ক্লাস নিতে হচ্ছে। ৩ ক্রেডিটের একটা কোর্সে ৩৯টা ক্লাস নিতে হয়। ৩০টির বেশি ক্লাস নিতে হবে। অথচ আমরা কতটি ক্লাস নিচ্ছি? কোর্স কিন্তু শেষ হচ্ছে তবে পর্যাপ্ত ক্লাস নিতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, ক্লাস তিন ধরনের, থিওরি ক্লাস, ল্যাবরেটরি ক্লাস এবং রিসার্চ বা প্রজেক্টের কাজ। থিওরি এবং ল্যাব ক্লাসের বাইরেও আমাদের রিসার্চ বা প্রজেক্টের কাজ রয়েছে, সেগুলোও করতে পারছি না । এছাড়াও খাতা দেখা, রেজাল্ট শিট প্রস্তুতসহ আমাদের অনেক কাজ রয়েছে। এত চাপের কারণে সেগুলোও সময়মতো করতে পারছি না।
এ বিষয়ে বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. এ কে এম রায়হান উদ্দিন বলেন, প্রতিটি সেমিস্টারে একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ের মাধ্যমে আমরা একাডেমিক ক্যালেন্ডার ঘোষণা করে থাকি। আমরা আসলে একাডেমিক ক্যালেন্ডার সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি না। বাস্তবায়ন করতে ত্রিমুখী সমস্যায় পড়তে হয়। এটার পেছনে মূল সমস্যা হলো শিক্ষক স্বল্পতা। আমাদের ১৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ৯ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে আছেন। ৬ জন শিক্ষক দিয়ে একটি বিভাগ পরিচালনা করাটা খুব কঠিন ব্যাপার।
তিনি বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে আমরা মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছি না। প্রস্তুতি ছাড়াই আমাদের ক্লাসে যেতে হচ্ছে। একেকজন শিক্ষককে পাঁচ ছয়টি করে কোর্স নিতে নিতে হচ্ছে।
শিক্ষক সংকটের বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রশাসন এবং ডিন বরাবর বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু এর কোনো সমাধান পাইনি। আমরা চাচ্ছি যে, বিভাগে অতি দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক। এতে আমরা আমাদের একাডেমিক কার্যক্রমও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারব।
সার্বিক বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড এ এফ এম আবদুল মঈনের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার তার দফতরে গেলেও তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেননি। মুঠোফোনে একাধিক কল দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সারাবাংলা/আইই