জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯’এ পদার্পণ
১৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:২৬
জবি: পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠা শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অবিশ্বাস্যও বটে। ঠিক সেটাই করে করে দেখিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের জগা বাবুর পাঠশালা যে একদিন দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হবে, তা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। পুরান ঢাকার সদরঘাটে এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। ২০০৫ সালে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বীকৃতি পায় দেশের অন্যতম প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সাফল্যের ১৮ বছর পূর্ণ করে ১৯ বছরে পদার্পণ করছে জবি। পাশাপাশি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পাড়ি দিয়েছে ১৫০ বছর।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ২০ অক্টোবরকে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রসারে এই বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস।
উচ্চমানের পার্থিব শিক্ষার সঙ্গে ব্রাহ্ম ধমের্র মূল মতবাদ সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের জানানোর জন্য আরমানিটোলায় ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব প্রাঙ্গণে চালু করা হয় এই অবৈতনিক স্কুল। সেই সময় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের পরিবর্তিত রূপই আজকের জবি। ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাশের মাধ্যমে এটি একটি পরিপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। পূর্বের কলেজের শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য হয়। তাদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। ২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সনদ লাভ করে। জবি’র অধীনে ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। অধ্যাপক ড. এ কে এম সিরাজুল ইসলাম খান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে সাড়ে সাত একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও কেরানীগঞ্জ জেলখানার বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিজস্ব ৭ দশমিক ৫ একর কেনা জমি আছে। আর জবি’র নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য রয়েছে ২০০ একর জমি। যার ১৮৮ দশমিক ৬০ অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে, বাকি ১১ দশমকি ৪০ একর জমির অধিগ্রহণ চলমান রয়েছে। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭টি অনুষদে ৩৮টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬৮০ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে অধ্যাপক রয়েছেন ১৫৬ জন। এর মধ্যে গ্রেড ১ এর ৩৬ জন, গ্রেড ২ এর ৪৬ জন ও গ্রেড ৩ এ ৭৪ জন। এছাড়াও সহযোগী অধ্যাপক ১৭৭ জন, সহকারী অধ্যাপক ২৯০ জন ও প্রভাষক ৬৭ জন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৮ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়াও এমফিল’এ ২৬৫ জন ও পিএইচডি’তে ১৫১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ পর্যন্ত জবিতে ৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হোন। বর্তমানে তিনজন শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি বিভাগে প্রফেশনাল প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, আরও বেশ কয়েকটি বিভাগে চালুর প্রস্তুতি রয়েছে। এখানে ৭৩৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। যার মাধ্যমে কেরানীগঞ্জে প্রায় ২০০ একর জায়গার উপর নির্মিত হচ্ছে জবি’র আধুনিক ক্যাম্পাস। এছাড়াও ছাত্রীদের জন্য ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’ নামে ১৬ তলাবিশিষ্ট হলে ১২০০ ছাত্রীর আসন ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবাসন ও যানবাহনসহ শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেদের জানান দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে জবির শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীরা। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু রয়েছে। অনেক আগেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিবেদনে এ-গ্রেড ভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে জবি। বিসিএসসহ সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষাতে গোপন বার-কোড পদ্ধতি চালু করার মাধমে জালিয়াতি রোধে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে জবি প্রশাসন। ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথমবারের মতো চালু হয় লিখিত ভর্তি পরীক্ষা। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে জবি।
ইউজিসি’র প্রকল্পের মাধ্যমে নেটওয়ার্কিং অ্যান্ড আইটি দফতরের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি বিভাগ এবং দফতরে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করার জন্য ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সাহায্যে একটি ব্যাকবোন নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তারবিহীন দ্রুত গতির ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টি ই-নথির যুগে প্রবেশ করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউজিসি’র বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) মূল্যায়নে দেশের ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে জায়গা পেয়েছে জবি। এছাড়াও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্পেনের সিমাগো ইনস্টিটিউশন র্যাংকিংয়ে রসায়ন বিষয়ে গবেষণা সূচকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেছে জবি। এছাড়াও ২০১৯ এসএ গেমস’এ বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ী মারজান আকতার প্রিয়া জবি’র শিক্ষার্থী। এ বছর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত ১ হাজার ৬৭৬ জন শিক্ষার্থীকে মেধা ও অবৈতনিক দুই ক্যাটাগরিতে ৫৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকার বৃত্তি দিয়েছে জবি।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেবা খাতের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবহন। পাঁচ বছর আগেও পরিবহনের জন্য সীমিতসংখ্যক যানবাহন ছিল। বর্তমানে ৫৬টি যানবাহন পরিবহন পুলে বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অধিকতর পরিবহন সুবিধা দেওয়ার জন্য বিআরটিসি থেকে ভাড়া করা বাস ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ক্যান্টিনটি সংস্কার করে আধুনিক ক্যাফেটিরিয়ায় রূপান্তর করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবা সম্প্রসারিত হয়েছে, এখন প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১০টি শাখার মাধ্যমে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক ডিজিটাল গ্রন্থাগার রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। প্রায় ৬০টি ল্যাপটপের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ই-বুকস ও অনলাইন জার্নাল সেবা চালু রয়েছে। মর্যাদা ও ঐতিহ্যের কালো গাউন পরে সমাবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শেষ করার প্রত্যাশা থাকে সব শিক্ষার্থীরই। জবি শিক্ষার্থীদের সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ হয় এবছরের শুরুতেই। প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পর ১১ জানুয়ারি ২০২০-এ প্রথম সমাবর্তন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুরান ঢাকার ধূপখোলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে আয়োজিত হয় এই সমাবর্তন। সমাবর্তনে অংশ নেন প্রায় ১৮ হাজার গ্র্যাজুয়েট ও অন্য ডিগ্রিধারী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৮৯৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের কাজ সরকারের বিভিন্ন দফতরের সমন্বয়ে দ্রুত সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে, যাতে নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন কার্যক্রম এগিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সব সমস্যার সমাধান নতুন ক্যাম্পাসে গিয়েই সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশের জন্ম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ইতিহাস থেকে অবশ্যই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তবেই জবি সার্থকতা লাভ করবে বলে আশা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সারাবাংলা/এএসএস/এনএস