বাইরে বর্জ্যের স্তূপ, খালি পড়ে আছে ১৩ কোটি টাকার ল্যান্ডফিল
১৯ অক্টোবর ২০২৩ ১১:০৩
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজার বাসিন্দার পৌরসভা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর। দিনে বর্জ্য তৈরি হয় প্রায় ৫০ টন। খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেললে পরিবেশ নষ্ট হওয়াসহ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি বিবেচনায় পৌরসভাটি নির্মাণ করে একটি স্যানিটারি ল্যান্ডফিল। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১৩ কোটি টাকা। অথচ নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ল্যান্ডফিল কাজে আসছে না। এখনো বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন খালি জায়গায়।
পৌরবাসী বলছেন, খোলা জায়গায় ময়লা ফেলার কারণে আবাসিক এলাকায় দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়েছে। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। রোগ-বালাইয়ের প্রকোপও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এ ধরনের জায়গায় বর্জ্য ফেলা হলে তা আশপাশের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হবে। বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করে নির্মিত ল্যান্ডফিলটি কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে তৃতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নতিকরণ প্রকল্পের আওতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভায় ল্যান্ডফিল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২০ সাালের ৩০ সেপ্টেম্বর এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কাজ পিছিয়ে যায়। ল্যান্ডফিল নির্মাণের কাজ শেষ হয় এর এক বছর পর। জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণসহ এই ল্যান্ডফিলের জন্য কাজে মোট ব্যয় হয় ১২ কোটি ৯৫ লাখ ১৪ হাজার ২৩৫ টাকা।
দুই বছর হলো স্যানিটারি ল্যান্ডফিলটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে থাকলেও তা কোনো কাজেই আসছে না। এখনো পৌরসভার সব বর্জ্য ও ময়লা-আর্বজনা ফেলা হচ্ছে পৌরসভার নয়াগোলায় পুলিশ লাইনসের বিপরীতে খোলা জায়গায়। সেখান থেকে আবাসিক এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। অভিযোগ ও বাধা দিলেও আবাসিক এলাকায় বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা যায়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
নয়াগোলার বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি সরকারি প্রকল্প হয়েছে। তাই এখানে খোলা জায়গায় আর ময়লা ফেলা হবে না। কিন্তু শুধু শুনেই আসছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি। পৌরসভার যত ময়লা-আর্বজনা, প্রতিদিন তা জমা করে এখানে আবাসিক এলাকায় এনে ফেলা হয়। বারবার পৌর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি।
একই এলাকার রিকশাচালক আজিজুল হক বলেন, ময়লা ফেলার জায়গার সামনে আধা কিলোমিটার পর্যন্ত দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। যাত্রীদেরও খুব সমস্যায় পড়তে হয়। একটু বৃষ্টি হলেই গন্ধ তীব্র আকার ধারণ করে। এখানে বসবাস করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। আমাদের দাবি, আবাসিক এলাকায় ময়লা-আর্বজনা না ফেলে শহরের বাইরে ফেলা হোক।
স্থানীয় সায়েমা খাতুন বলেন, স্বাভাবিক সময়েই দুর্গন্ধ ছড়ায়। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। চরম অবস্থা তৈরি হয়। বাসার পাশেই এভাবে বর্জ্য ফেলে রাখা হয়েছে। এখন ছেলে-মেয়েরা ঘনঘন নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তাদের। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই।
জেলা শহরের দ্বারিয়াপুর এলাকার বাসিন্দা আহমেদ আলী বলেন, স্যানিটারি ল্যান্ডফিলটি অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা আছে। কিন্তু কোনো কার্যক্রম নেই। তাহলে এত আধুনিক-সুযোগ সুবিধা দিয়ে এমন ল্যান্ডফিল কেন করা হলো, তা বোধগম্য নয়। ব্যবহার যদি না করা হয়, তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ল্যান্ডফিল তৈরি করার দরকার কী ছিল?
স্যানিটারি ল্যান্ডফিল প্রস্তুত থাকলেও কাজে আসছে না বলে স্বীকার করেন এর তত্ত্বাবধায়ক মো. ওয়াসিম। তিনি বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে ল্যান্ডফিল পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু এখানে ময়লা-আর্বজনা ফেলা হয় না। আপাতত নয়াগোলায় খোলা জায়গায় ফেলা হচ্ছে পৌরসভার সব বর্জ্য। কবে নাগাদ এখানকার (ল্যান্ডফিল) কার্যক্রম শুরু হবে, তাও জানি না।
খোলা জায়গায় ফেলা ময়লা-আর্বজনা পরিবেশ দূষণের কারণ হবে উল্লেখ করলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার শহর পরিকল্পনাবিদ মোহা. ইমরান হোসাইন। বলেন, বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটর কারণে স্যানিটারি ল্যান্ডফিলটি পুরোপুরি চালু করা যায়নি। তবে বর্তমানে সেখানে পৌরসভার মধ্যে থাকা মনুষ্যবর্জ্য ফেলার কাজ চলছে। ল্যান্ডফিলটি পুরো চালু করার আগে পৌরবাসীকে সচেতন করে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা। আশা করি, শিগগিরই ল্যান্ডফিলটির কার্যক্রম শুরু হবে।
খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলায় ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা জানালেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেন, খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেললে এর আশপাশের বাসিন্দারা ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকবেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। তার মেডিকেল বর্জ্য থাকলে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ।
জানতে জইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. সালেহ্ উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের লোকবল ও সরঞ্জামের সংকট রয়েছে। পাশাপাশি পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য বসতবাড়ি থেকেই আলাদা করে ডাস্টবিনে ফেলার বিষয়ে পৌরবাসীর সচেতনতার অভাব রয়েছে। প্রধানত এই দুই কারণে স্যানিটারি ল্যান্ডফিলটি চালু করতে পারছে না পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।
পৌরবাসীকে সচেতন করে তোলার কাজ চলছে জানিয়ে মেয়র সালেহ্ উদ্দীন বলেন, বর্জ্য আলাদা করে ফেলতে বাড়িতে বাড়িতে আধুনিক ডাস্টবিন প্রদান ও জনসচেতনতা তৈরিতে উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। বর্জ্য পৃথক রাখার জন্য ১২ হাজার ডাস্টবিনও দেওয়া হয়েছে পৌরবাসীকে।
সারাবাংলা/টিআর