ধান আবাদে আইওটি: অ্যাপ জানাবে সেচের চাহিদা, যন্ত্র বন্ধের সময়
২০ অক্টোবর ২০২৩ ২২:৩৭
ঢাকা: ধান চাষে সেচ দিতে হলে এখন আর সেচযন্ত্রের কাছে যেতে হবে না কৃষকদের। শুধু তাই নয়, কখন জমিতে পানি দিতে হবে কিংবা সেচযন্ত্র বন্ধ করে ফেলতে হবে— এ তথ্যও পাওয়া যাবে মোবাইল ফোনের মেসেজে ও অ্যাপের মাধ্যমে। এর ফলে জমিতে যেমন সঠিক সময়ে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে, তেমনি ভূগর্ভস্থ পানির অপচয়ও রোধ হবে। কমে যাবে সেচের খরচ।
অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং (এডব্লুডি) প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে ধান চাষে প্রথমবারের মতো আইওটি-ভিত্তিক (ইন্টারনেট অব থিংস) এই স্মার্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন কৃষি প্রকৌশলী ড. সুরজিৎ সরকার (দুরন্ত)।
এই প্রকৌশলী জানিয়েছেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহার হলে বোরো মৌসুমে সেচ কাজে পানির অপচয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যাবে। আর সেচে খরচ কমায় ধান চাষে হেক্টর প্রতি পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা উৎপাদন খরচ কমবে কৃষকদের। আগামী বোরো মৌসুমে বরিশাল এলাকায় মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগ থেকে ড. সুরজিৎ সরকার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ধানের চারা রোপণে দেশে ব্যবহারের লাগসই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে অ্যাগ্রোমেক ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এডিআই) ফাউন্ডেশনে পরিচালক পদে কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগেই তিনি এই গবেষণা করেছেন।
ড. সুরজিৎ সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকের কাছে মেসেজ যাবে, কখন ধান খেতে পানি দিতে হবে, কখন পানি বন্ধ করতে হবে। ধানের মাঠে পানি কমে গেলে কৃষকের কাছে মেসেজ চলে যাবে। এখন পর্যন্ত ধান চাষে সেচযন্ত্রের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হয়নি। এর ফলে কৃষকের মাঠে যাওয়া লাগবে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারা মোবাইলে মেসেজ পাবেন। অ্যাপের মাধ্যমেও জানতে পারবেন কখন পানি দিতে হবে, কখন পানি বন্ধ করতে হবে।’
অ্যাগ্রোমেকের পরীক্ষাগারে এই প্রযুক্তির পুরো গবেষণা শেষ হয়েছে। আগামী বোরো মৌসুমে বরিশাল এলাকায় মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে জানিয়ে ড. সুরজিৎ বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকের খরচ হবে ৩০ হাজার টাকার মতো। এর ফলে পানির অপচয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যাবে। সেচে উৎপাদন খরচ কমায় সামগ্রিক উৎপাদন খরচ কমবে হেক্টর প্রতি পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।’
প্রযুক্তিটি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধান চাষে আইওটি প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের কৃষিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রথম দিকে এটি হয়তো ব্যয়সাপেক্ষ হবে। তবে ধীরে ধীরে এর ব্যয় আরও কমে যাবে। তখন এই প্রযুক্তি জনপ্রিয় হবে। ঘরে বসেই যদি সেচের প্রয়োজনীয়তার মেসেজ পাওয়া যায়, সেটি সেচের ব্যয় কমাবে, শ্রমেরও সাশ্রয় করবে। কৃষক এই প্রযুক্তিতে আকৃষ্ট হবে। এই প্রযুক্তি দেশের কৃষিকে আরও আধুনিক করতে ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) শিবেন্দ্র নারায়ণ গোপ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধান চাষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেচের পানি সাশ্রয়ী অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং (এডব্লুডি) প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে আইওটি প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে এবং বেশ সাফল্য পাওয়া গেছে। ধান চাষেও আইওটি প্রযুক্তির ব্যবহারের জন্য বিএডিসি ওয়েব-এআইএস নামক একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ হবে সেন্সর-নির্ভর। ধানের শেকড় মাটির নিচে সাধারণত ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত গভীরে যায়। সেন্সরটি যদি ৬ ইঞ্চি নিচে বসানো হয়, তবে তা সেচের পানির প্রয়োজনীয়তার সঠিক বার্তা দেবে। এমন প্রযুক্তি কৃষকের কাছে পৌঁছানো কঠিন হলেও প্রকল্পটির মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য সব ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রেও আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রতি জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএডিসির এই প্রকল্পের কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয়েছে।
শিবেন্দ্র নারায়ণ আরও বলেন, ‘ধান আবাদে আইওটির ব্যবহার নিয়ে ড. সুরজিৎ সরকারের গবেষণা সম্পর্কেও জেনেছি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগ পরিচালিত একটি প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে তিনি আগেও আইওটি-ভিত্তিক সৌর সেচ প্রযুক্তির বাস্তবায়নে সরাসরি কারিগরি সহায়তা দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে আইওটি-ভিত্তিক সেচ গবেষণায় বেগুন, টমেটো ও মরিচ চাষে বেশ সফলতা পাওয়া গেছে।’
দেশের প্রধান ফসল ধান চাষ ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত সেচ পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। এই পদ্ধতিতে সেচ দেওয়ায় ধান চাষে পানির ব্যবহার অনেক বেশি হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় ও আকর্ষণীয় প্রযুক্তির অভাবে কৃষকদের মূল্যবান পানি সম্পদ ব্যবহার করতে হয় অনেক বেশি। স্মার্ট ও টেকসই কৃষির জন্য ইন্টারনেট অব থিংস তথা আইওটি-ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুললে এ অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন কৃষিসংশ্লিষ্টরা। বলছেন, এমন প্রযুক্তি ব্যবহারে শুরুতে খরচ থাকলেও তা কৃষকের শ্রম ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাবে, সময়ও সাশ্রয় করবে। সার্বিকভাবে কমাবে উৎপাদন খরচ।
অ্যাগ্রোমেক ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (এডিআই) পরিচালক ও কৃষি প্রকৌশলী ড. সুরজিৎ সরকার (দুরন্ত) সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ধান চাষে সেচের পানি সাশ্রয় করতে নিজস্ব প্রোগ্রামিং ও প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার টেকনিক দিয়ে উদ্ভাবন করেছেন এই স্মার্ট প্রযুক্তি। গবেষণাগারের পরীক্ষায় এই প্রযুক্তিতে পাওয়া গেছে প্রত্যাশিত সাফল্য। এখন অপেক্ষায় মাঠে পরীক্ষার।
অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং (এডব্লুডি) প্রযুক্তি ধান চাষের জন্য একটি প্রমাণিত ও টেকসই পদ্ধতি। এই প্রযুক্তির মূলে রয়েছে পর্যায়ক্রমে ধান চাষের জমি শুকানো ও প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দেওয়া। পদ্ধতিটি কেবল সেচের পানি সংরক্ষণই করে না, বরং ধানের সার্বিক উৎপাদন খরচও কমায়। এই নতুন উদ্ভাবন প্রক্রিয়াটিকে আরও স্মার্ট করে তুলেছে।
প্রযুক্তিটির সঙ্গে একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ যুক্ত থাকলে রিয়েলটাইমে কৃষক ও সেচ যন্ত্র পরিচালনাকারীকে তথ্য দেবে এবং একইসঙ্গে মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে কৃষককে জানাবে কখন পাম্প চালু করতে হবে বা বন্ধ করতে হবে। এই একই অ্যাপ থেকে পাম্পটি চালু বা বন্ধ করবার সুযোগও আছে বলে জানিয়েছেন উদ্ভাবক।
ড. সুরজিৎ জানান, মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, কৃষক পানি পেলে তা ব্যবহারে পরিমিত হয় না। অন্যদিকে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ অনেক স্থানে বোরো মৌসুমে ধান চাষের ক্ষেত্রে পানির সংকট রয়েছে। তার উদ্ভাবন এই পানির অপচয় রোধ করবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মঞ্জুরুল আলম ও অধ্যাপক ড. চয়ন কুমার সাহা এই গবেষণায় প্রয়োজনীয় উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান ড. সুরজিৎ। বলেন, প্রযুক্তিটির মূল ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আরও কিছু প্রযুক্তি এরই মধ্যে গবেষণার পর্যায়ে আছে, যা শিগগিরই মাঠপর্যায়ে পরীক্ষার জন্য নেওয়া হবে। প্রযুক্তিটির সঙ্গে তারই উদ্ভাবিত স্মার্ট সোলার লাইট ট্র্যাপ ব্যবহার করলে একই সঙ্গে ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকর ধ্বংসসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার কমানো যাবে। স্মার্ট সোলার লাইট ট্র্যপের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলোর জন্য মৌসুম শেষেও কৃষক বাড়িতে ব্যবহার করতে পারবেন।
আইওটিভিত্তিক এই সেচ ব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো এর অতি সাধারণ ব্যবহার ও স্থাপন কৌশল। কৃষকদের সক্ষমতার কথা মাথায় রেখে নকশা করায় এটি পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণও প্রয়োজন হবে ন্যূনতম। অর্থাৎ ক্ষুদ্র কৃষক বা সমবায় গোষ্ঠীও অনায়াসে এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারবে। এর ব্যাপক সম্প্রসারণ সম্ভব হলে সেচের পানির সাশ্রয়সহ ধান চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়বে, যা বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
কৃষিতে আইওটি প্রযুক্তি কৃষিতে প্রযুক্তি ধান চাষ বোরো আবাদ সেচে আইওটি প্রযুক্তি