ঝরে পড়াদের শিক্ষা: কোটি টাকা লুটের অভিযোগ এনজিও দিশার বিরুদ্ধে
২৩ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৩০
যশোর: যশোরে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নে লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি এ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী যশোরের একটি এনজিও ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে অন্তত দুই কোটি টাকা ‘হাপিস’ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঝরে পড়া শিশুদের জন্য এ প্রকল্পের স্কুলগুলোর বাড়ি মালিকরা ভাড়া পাননি, বেতন বকেয়া রয়েছে শিক্ষক, সুপারভাইজারদের। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের পোশাক, ব্যাগ। এভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করে ওই টাকা লুটে নিয়েছে ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’।
অভিযোগকারীদের দাবি, ‘দিশার’ অফিস জালিয়াতির কারখানা। প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তাদের নিজেদের তৈরি করা। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, সেটিও নিজেরা তৈরি করেছে। ব্যাংক থেকে স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করলেই তা ধরা পড়ে যাবে। এসব বিষয় তুলে ধরে প্রকল্পেরই উপজেলা ম্যানেজার উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালককে প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারা দেশের ঝরেপড়া শিশু কিশোরদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক জেলা থেকে একটি লিড এনজিও নির্বাচন করা হয়। যশোরে লিড এনজিও হিসেবে ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ ছয়টি উপজেলা ও যশোর পৌরসভায় (দুটি এরিয়ায় বিভক্ত করে ১ ও ২) প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং ভুক্তভোগীরা টাকা না পাওয়ায় যশোরের প্রেসক্লাবে ২০২১ ও ২০২২ সালে দুটি প্রেসকনফারেন্স করে। সেখানে নানা অনিয়মসহ সমস্যা তুলে ধরেন ভুক্তভোগীরা।
অভিযোগকারীদের দাবি, কার্যক্রম শুরুর আগে ঝরে পড়া শিশুর তথ্য সংগ্রহে জরিপকারীদের ৮০ ভাগ টাকা এখনও পাওনা রয়েছে। শিক্ষক ও সুপারভাইজার নিয়োগে ব্যাপক অর্থবাণিজ্য হয়েছে। গত ৩০ জুন ২৩ প্রকল্প শেষ হলেও শিক্ষক, সুপারভাইজারদের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলের জন্য ভাড়া নেওয়া ঘরের ভাড়া পাননি বাড়ি মালিকরা।
সূত্র জানায়, যশোরের ছয়টি উপজেলার প্রায় ৪০০ স্কুল কেন্দ্রের এক বছরের ভাড়া বকেয়া আছে। দেড় হাজার টাকা হিসেবে এই ৪০০ স্কুলের এক বছরের ভাড়া ৭২ লাখ টাকা। আর যশোর পৌরসভার ৬০টি কেন্দ্রে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে দেড় বছরের ভাড়া দেওয়া হয়নি। এই ভাড়ার পরিমাণ ৩০ লাখ টাকা। অথচ এই কোটি টাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত এনজিও উত্তোলন করে নিয়েছে।
এছাড়াও যশোর পৌরসভার ৬০টি স্কুল কেন্দ্রের ৬০ শিক্ষকের ১০ হাজার টাকা করে দুই মাসের বেতন বাবদ ১২ লাখ টাকা, ছয় উপজেলার ৪০০ জন শিক্ষকের পাঁচ হাজার টাকা করে দুই মাসের ৪০ লাখ টাকা, উপজেলার ৫০ জন সুপারভাইজারের ১৫ হাজার টাকা করে দুই মাসের বেতন ১৫ লাখ টাকা, পৌরসভার ছয়জন সুপারভাইজার ও উপজেলার আটজন ম্যানেজারের ২০ হাজার টাকা করে দুই মাসের সাত লাখ ২০ হাজার টাকা দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা উত্তোলন করে হজম করে নিয়েছে বলে অভিযোগ।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে এই উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য ঘরভাড়া নেওয়া হয় ওই গ্রামের মোসলেম বিশ্বাসের। তিনি জানান, স্কুলঘর ভাড়া নেওয়ার পর থেকে তিনি একদিনেরও ভাড়া পাননি।
ওই কেন্দ্রের শিক্ষক মোসলেম বিশ্বাসের পুত্রবধূ মোছা. জুইনা খাতুন জানান, কেন্দ্রে প্রথম যে শিক্ষক ছিলেন, বেতন না পেয়ে তিনি ৪/৫ মাস পর চলে যান। এরপর তিনি কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। তিনিও পাঁচ মাস পড়িয়ে কোনো বেতন পাননি।
একই উপজেলার ধর্মগাতি কেন্দ্রটি ওই গ্রামের জহুরুল ইসলামের বাড়িতে। জহুরুল ইসলামের ছেলে মাজহারুল ইসলাম জানান, তারাও কেন্দ্রের কোনো ভাড়া পাননি। তার স্ত্রী ঝরণা খাতুন ওই কেন্দ্রের শিক্ষিকা। তিনিও কোনো বেতন-ভাতা পাননি।
বাঘারপাড়ার জহুরপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামের কেন্দ্রের শিক্ষক জেসমিন খাতুন জানান, তার আট মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। আর কেন্দ্রের বাড়িমালিক নাজিম মেম্বর কোনো ভাড়া পাননি।
জহুরপুর ইউনিয়নের বেতালপাড়া কেন্দ্রের বাড়ি মালিক মোক্তার হোসেনও কোনো ভাড়া পাননি।
এই ইউনিয়নের সুপারভাইজার আব্দুর রহিম জানান, কোনো কেন্দ্রের বাড়ি মালিক ভাড়া পাননি। কিন্তু দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। তার নিজের বেতন এবং সোশ্যাল বেনিফিটের টাকাও বকেয়া রয়েছে।
প্রকল্পের উপজেলা ম্যানেজার মো. আব্দুল্লাহ জানান, তার দুই মাসের বেতন এবং এক বছরের টিএ বিল পাওনা রয়েছে। তিনি শুধু একা নন, এভাবে প্রত্যেক শিক্ষক, সুপারভাইজার, ম্যানেজারের বেতন বকেয়া রয়েছে। ভাড়া পাননি বাড়ির মালিকরা। কিন্তু কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা ওইসব টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদেরকে নিম্নমানের পোশাক, ব্যাগ দিয়ে বরাদ্দের টাকা লুটপাট করেছে।
মো. আব্দুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার অফিস জালিয়াতির কারখানা। প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তাদের নিজেদের তৈরি করা। শিক্ষক, বাড়ি মালিকদের স্বাক্ষর নিজেরা করে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে; সেটিও দিশা’র কর্মকর্তারা নিজেরা তৈরি করেছে। ব্যাংক থেকে স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করলেই তা ধরা পড়ে যাবে। এইসব জাল কাগজপত্রের প্রমাণও তাদের কাছে রয়েছে। এ জন্য তিনি উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র সহকারী পরিচালককে প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানা বলেন, ‘জাল-জালিয়াতি বা অনিয়ম-দুর্নীতির সব অভিযোগ মিথ্যা।যারা এই প্রকল্পে কাজ করতে পারেনি তারা এ ধরণের অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যাবতীয় হিসাব তাদের কাছে রয়েছে।’
যশোর উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো আমাকে চিঠি দিয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলেছেন। চাহিদা অনুযায়ী আমি কাগজপত্র ও
প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।’
সারাবাংলা/ইআ