মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে ইসির সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন
২৩ অক্টোবর ২০২৩ ২১:৫৯
ঢাকা: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে নভেম্বরেই। এরই মধ্যে নির্বাচন নিয়ে বিদেশি বিভিন্ন মহলেরও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) জাতীয় এই নির্বাচন আয়োজন নিজস্ব রোডম্যাপ ধরেই এগুচ্ছে। নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করলেও পুরনো কিছু ইস্যু এখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে ইসির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতের অভিজ্ঞতায় এবারের নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে ভাবিয়ে তুলেছে। একইসঙ্গে সম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা কমিশনের ক্ষমতাকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সব মিলিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ইসি।
সংবিধান অনুযায়ী, আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রযেছে। সে আলোকে আগামী মাসের (নভেম্বর) দ্বিতীয় সপ্তাহে তফসিল এবং নতুন বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়েছে ইসি। এরই মধ্যে নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার দাবিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অন্য প্রায় সব রাজনৈতিক দল নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এ দাবির পক্ষে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপও রয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সরব হয়ে উঠেছে।
নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও নানা কারণে তাতে আস্থা রাখতে পারছে না বিভিন্ন মহল। বরং বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর মাঠ প্রশাসনের বেশ কিছু ঘটনা আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই ইসি প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কমিশনের ক্ষমতা একের পর এক চ্যালেঞ্জর মুখে পড়ছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইসির আদেশ-নিষেধ আমলে নিচ্ছেন না। এমনকি কমিশন কার্যালয়ে একজন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের আসৌজন্যমূলক আচরণ যেন ইসির নিয়ন্ত্রণহীনতার উনুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
কমিশন সচিবালয় বলছে, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি অভিযুক্ত ১৩৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা আমলে নেওয়া হয়নি। এর মাধ্যমে ইসির ক্ষতমা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সবশেষ ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থীর ওপর হামলার বিষয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে ব্যস্থা নিতে ইসির নিদের্শনাও গুরুত্ব পায়নি। এমন সব ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণে মাঠ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরাও।
বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের বাস্তবতায় নিরপেক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচনকালীন প্রশাসনের নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের ইস্যুটি। এটি করাতে হলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যা কোনো দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে সম্ভব বলে জনগণ বিশ্বাস করে না।
ড. বদিউল আলম বলেন, গত প্রায় দেড় দশকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময়ের কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে বলেও মনে হয়নি। নিকট অতীতের বাস্তবতায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনও ইসি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে বলে আশা করা যায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করেন সবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সরকারি দলের ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও বিরোধী প্রার্থী ও সাধারণ ভোটারদের জন্য নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ ছিল না। ফলে নির্বাচনকালে মাঠ প্রশাসনকে ইসি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
একই বিষয়কে চ্যালেঞ্জ মনে করেন সাবেক নির্বচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনও। তিনি বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠ করতে হলে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ডিসি-এসপিদের নিরপেক্ষ ভূমিকা অতি জরুরি। তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখাই হবে আগামী নির্বাচনে ইসির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
মাঠ প্রশাসনে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা পালন প্রসঙ্গে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরলেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘নির্বাচনের সময় প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারী নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবেন’।
ড. তোফায়েল সারাবাংলাকে বলেন, সংবিধানে ওই নির্দেশনা থাকলেও সহায়তা না করলে তার বিধান কী, সেটি বলা নেই। সে কারণে নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছে না। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় পুলিশের কোনো কোনো এসপি বা ওসি প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইছেন, ডিসি নির্দিষ্ট দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এসব জেনেও পুলিশ সদর দফতর ও জনপ্রশাসন সচিবালয় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল অউয়াল সারাবাংলাকে বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষ ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। নির্বাচন আয়োজন একটি কঠিন কর্মযজ্ঞ। সময় যত ঘনিয়ে আসছে, চ্যালেঞ্জ তত বাড়ছে। এককভাবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সব কিছু করা সহজ নয়। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাতীয়-নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বাচন কমিশন মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ সংসদ নির্বাচন