Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কর্ণফুলীর বুক চিড়ে ইতিহাস যাত্রার অপেক্ষায় দেশ

রমেন দাশগুপ্ত ও ইমরান চৌধুরী
২৬ অক্টোবর ২০২৩ ২২:১৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: কর্ণফুলী নদীর দুই তীর পতেঙ্গা আর আনোয়ারায় পতপত করে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। রক্তঋণে পাওয়া এই পতাকা জানান দিচ্ছে, আর মাত্র কিছুসময়— এর পরই বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে আরেকটি গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। খরস্রোতা কর্ণফুলীর বুক চিড়ে বাংলাদেশ নির্মাণ করেছে সুড়ঙ্গপথ। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গপথ বা টানেল নির্মাণের ইতিহাস আর কোনো দেশের নেই।

একদিন পরেই বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে টানেলের যুগে। কর্ণফুলীর বুকে ঢেউয়ে পাল তুলে বরাবরের মতো ছুটবে জাহাজ, নৌকা আর নদীর বুক চিড়ে তলদেশ দিয়ে নির্মিত টানেলের ভেতর দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটবে যন্ত্রযান। এমনই এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

কর্ণফুলীর দুই তীরে এখন সাজ সাজ রব। শনিবার (২৮ অক্টোবর) সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতীক্ষীত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের’ উদ্বোধন করবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী টানেল পাড়ি দিয়ে নদীর দক্ষিণ তীরে গিয়ে কেইপিজেড মাঠে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের আগে বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রামের গণমাধ্যমকর্মীদের টানেল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন টানেল প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ।

টানেল নির্মাণের চার বছরের কর্মযজ্ঞ শেষে এবার দুই প্রান্তে দেখা গেল উদ্বোধনের বিপুল আয়োজন। সাগরতীরের সিডিএ আউটার রিং রোড ধরে পতেঙ্গায় টানেলের প্রবেশপথ পর্যন্ত সেজেছে নতুন সাজে।

পতেঙ্গা প্রান্তে দেখা গেছে, টানেল ও আউটার রিং রোডের সংযোগস্থল গোলচত্বর লাল-সবুজের পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কাঠের স্থাপনায় লেখা হয়েছে ‘জয় বাংলা’। গোলচত্বরসহ পুরো রিং রোডের বিভাজক, গাছপালা রঙিন করে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। গোলচত্বর পার হওয়ার পর টানেলে ঢোকার দু’টি সড়ক মিলবে। একটি ‘অতিরিক্ত উচ্চতার যানবাহন ফিরে যাওয়ার পথ’। আরেকটি সাধারণ যানবাহন যাওয়ার পথ। প্রবেশমুখ থেকে সংরক্ষিত এলাকা শুরু, যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে নৌবাহিনী।

বিজ্ঞাপন

নৌবাহিনীর নিরাপত্তা তল্লাশি শেষে যানবাহন প্রবেশ করবে ওজন স্কেল। ইতোমধ্যে সেখানে স্ক্যানার বসানো হয়েছে। এরপরই টানেলের মূল প্রবেশপথ। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন উপলক্ষে টানেলের প্রবেশমুখ থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার এলাকায় সমুদ্র সৈকতের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লাইটার জাহাজ ও মাদার ভ্যাসেলকে শুক্রবার সকালের মধ্যে ওই এলাকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সমুদ্র সৈকতে দর্শনার্থী সমাগম শিথিল করা হয়েছে।

পতেঙ্গা-আনোয়ারা উভয়দিকে টানেলের প্রবেশমুখে উদ্বোধন মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ), পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সদস্য মোতায়েন আছে উভয়প্রান্তে।

আনোয়ারা প্রান্তেও দেখা গেছে একই চিত্র। সেখানে টোল প্লাজা স্থাপন করা হয়েছে। দু’টি আলাদা সুড়ঙ্গপথ, প্রতিটি পথ দু’লেইনের। সুড়ঙ্গের ভেতরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা আছে।

ছয় বছরের কর্মযজ্ঞ

কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে চীনের সাংহাই সিটির আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতে টানেল প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এর আগে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম টানেল টিউব নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন, এর মধ্য দিয়েই মূল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়।

টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হারে সুদে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বাকি অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার।

নির্মাণ কাজ করেছে চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলে প্রতিটি টিউব বা সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মত। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেইন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম ও প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এ ছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।

নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির পাশ থেকে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় নেমে যাওয়া এই টানেল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্বে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে স্থলপথে বের হবে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।

টানেল দিয়ে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি চলতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্মাণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এই টানেল দিয়ে যানবাহন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলবে। প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে।

স্বপ্নযাত্রায় ছিল চ্যালেঞ্জও

কর্ণফুলী নদীকে বলা হয় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ‍ভূমিকা রাখা চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণপ্রবাহ এই নদী। কর্ণফুলীর উত্তাল ঢেউয়ের লাগাম টেনে বুক চিড়তে কেমন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা জানালেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ। তার ভাষ্য, ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে যেমন সমস্যা পোহাতে হয়েছে, তেমনি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে খরস্রোতা নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গপথ নির্মাণে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রত্যেকটি প্রকল্পে কিছু কমন সমস্যা থাকে, যেমন- ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যা, এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটি জি টু জি প্রজেক্ট। ইআরডির সঙ্গে চীনের এক্সিম ব্যাংকের যখন ঋণচুক্তি সম্পন্ন হয় সে চুক্তির মধ্যে একটি ধারা ছিল। সেটা হচ্ছে- প্রকল্পের শুরুর আগেই যে জায়গা-জমির দরকার হবে সবগুলো তাদের হস্তান্তর করতে হবে। এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারে অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসনকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই, তারা বেশি শ্রম দিয়ে কাজটা সহজসাধ্য করে দিয়েছে।’

হারুনুর রশিদ বলেন, ‘প্রথমদিকে মাইলস্টোন পেমেন্ট উথড্র করতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে এক্সিম ব্যংকের সঙ্গে মিলে শুধুমাত্র টানেলসংক্রান্ত কাজে যেসব মাইলস্টোন আছে, সেগুলো উইথড্র করার সম্মতি নেওয়া হয়। আপনাদের মনে রাখতে হবে, টানেলের কাজ বলতে শুধুই ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার টানেলের কাজ। এর সঙ্গে যেসব রোড বা অন্যান্য আনুষাঙ্গিক স্থাপনা হয়েছে। এগুলো নন টানেল ওয়ার্ক। এটা করতে গিয়ে টেকনিক্যাল প্রবলেম ফেস করতে হয়েছে।’

বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে সুড়ঙ্গপথ নির্মাণে- এমন তথ্য দিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘টেকনিক্যালি বড় প্রবলেমটা ফেস করেছি, খরস্রোতা নদীর নিচে মাটি খননের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশীয় যারা প্রকৌশলী, তারা এমন একটি কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। আমাদের দেশের মাটির যে বৈশিষ্ট্য, তাতে এমন খননকাজ খুবই দুরূহ। এটা খুব বেশি চ্যালেঞ্জিং। যেহেতু সফট ও সিল্কি মাটি। শক্ত মাটিতে টানেল করা খুব সহজ।’

তিনি বলেন, ‘প্রথমে উত্তর টিউবের খনন কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সেটার উদ্বোধন করেন। যখন আমরা টানেলের এক্সপ্লোরেশনের কাজ শুরু করি, প্রায় পাঁচ শতাংশ যাওয়ার পর অনুভব করি খনন করার মেশিনটির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। বোরিং মেশিন নিচের দিকে না গিয়ে ঊর্ধ্বমুখে যাচ্ছে। কারণ মাটি সফট, শক্ত না। নিচের মাটি ও ওপরের মাটি হালকা হওয়ায় মেশিনটি ওপরে ওঠার একটি প্রবণতা দেখা যায়। সেটার জন্য আমাদের চারমাসের মতো এক্সপেরেশন কাজ বন্ধ ছিল। আমরা কাউকে সেটা বুঝতে দিইনি। পরে বিদেশ থেকে বিশেষ করে চীন থেকে আরও বিশেষজ্ঞ এনে এটা আমরা সমাধান করেছি।’

‘প্রথম টিউবটি খনন করতে আমাদের ১৭ মাস সময় লেগেছে। দক্ষিণ টিউবের কাজ আমরা ১০ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে পেরেছি। কারণ, আগে যেসব প্রবলেম ফেস করেছি এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি- তার কারণে আর অসুবিধা হয়নি।’

হারুনুর রশিদ আরও বলেন, ‘টানেলের এক একটি টিউবের মধ্যে ৮০ মিটার পরপর ইমার্জেন্সি স্কেট চ্যানেল আছে। এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। এছাড়া ৬০০ মিটার পরপর তিনটি জায়গায় এক টিউব থেকে আরেক টিউব যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেহেতু এটির আশেপাশের মাটিকে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ফ্রিজিং করতে হয়েছিল। ফ্রিজ হয়ে মাটি যখন চারিদিকে শক্ত হয়ে যায় তখন সেটাকে কেটে আমরা ওই সমস্যার সমাধান করি। ফ্রিজিং করার জন্য ৭০ থেকে ৭৫টি ছিদ্র করে টিউব দিয়ে মাইনাস ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে জমানো হয়েছিল। এসব সমস্যা আমরা সমাধান করেছি।’

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কর্ণফুলী অত্যন্ত খরস্রোতা নদী। সে হিসেবে এই টানেল নির্মাণ অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।’

৩৫০০ শ্রমিকের ঘাম-শ্রমের টানেল

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নদীর তলদেশের টানেলটি নির্মাণ করতে চীন ও বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। তাদের ঘামে-শ্রমেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ।

প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমরা সেতু বিভাগের প্রকৌশলী থেকে কর্মকর্তারা তো ছিলামই, কিন্তু গত ছয় বছর ধরে শ্রমিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। প্রথমদিকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন শ্রমিক এখানে কাজ করেছে। শেষের দিকে চীনের আরও ৭ থেকে ৮’শ শ্রমিক যুক্ত করা হয়। যখন যেরকম প্রয়োজন ছিল, সেভাবেই শ্রমিক কাজ করেছে। গড়ে চাইনিজ-বাংলাদেশি মিলে ৩ হাজার ৫০০ জনের মতো শ্রমিক ছিল। পরবর্তী সময়ে সেটা আস্তে আস্তে কমে।’

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঠিক দিকনির্দেশনায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের আন্তরিক সহযোগিতা এবং সেতু বিভাগের কর্মীদের ও প্রকল্প শ্রমিকদের নিরলস শ্রমে এ টানেল নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’

লাইফটাইম ১০০ বছর

‘লাইফটাইম’ ১০০ বছর ধরে প্রণীত নকশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি ১০০ বছর লাইফটাইমের গ্যারান্টি। প্রথম পাঁচ বছর চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন্স লিমিটেড এর অপারেশন ও মেইনট্যানেন্সের দায়িত্বে থাকবে। এর মধ্যে আমাদের প্রকৌশলীসহ কর্মীরা এটা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ পাবেন। আমর চাইব যে, পাঁচ বছরে আমরা নিজেরাই যেন টানেলের অপারেশন ও মেইনট্যানেন্সের সক্ষমতা অর্জন করি।’

২৯ অক্টোবর থেকে উন্মুক্ত

২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পরদিন ভোর ৬টা থেকে টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। ঢাকায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য দেন।

প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘মনে রাখত হবে, এটা কোনো সাধারণ ব্রিজ বা কালভার্ট নয়, এটা টানেল। থ্রি হুইলার, মোটরসাইকেল কোনোভাবেই টানেলে প্রবেশ করতে পারবে না। আমাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থাকবে। সেখান থেকে সবকিছু মনিটর হবে। এফ এম রেডিওতে যেভাবে ঘোষণা দেওয়া হয় বা তথ্য জানানো হয়, এখানেও সার্বক্ষণিকভাবে সেটা থাকবে। বিভিন্ন ধরনের কমেন্ট্রি দেওয়া হবে।’ ইতোমধ্যে চূড়ান্ত টোল হার ২৯ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে বলেও জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য গত আগস্টে টোল হার চূড়ান্ত করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে হলে ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার), জিপ ও পিকআপকে দিতে হবে ২০০ টাকা করে। আর মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে।

টানেলে দিয়ে যেতে হলে ৫ টন পর্যন্ত ট্রাককে ৪০০ টাকা, ৫ দশমিক ১ টন থেকে ৮ টনের ট্রাককে ৫০০, ৮ দশমিক ১ টন থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তিন এক্সেলবিশিষ্ট ট্রাক-ট্রেইলরের টোল চূড়ান্ত করা হয়েছে ৮০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রাক-ট্রেইলরকে দিতে হবে ১০০০ টাকা। এর বেশি ওজনের ট্রাক-ট্রেইলরকে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা করে অতিরিক্ত দিতে হবে।

টানেলের ভেতর দুর্ঘটনা সামলানো হবে যেভাবে

প্রকল্প পরিচালকের কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, টানেলের ভেতরে চলন্ত কোনো গাড়ি বিকল হয়ে গেলে কিংবা কোনো গাড়ি পথ হারিয়ে ফেললে করণীয় কী হবে। জবাবে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘টানেলের ভেতর পথ হারানোর কোনো সুযোগই নেই। সেফটি-সিকিউরিটির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা মহড়াও করেছি। টানেলের ভেতরে কোনো বাস-ট্রাক অথবা অন্য কোনো গাড়ি বিকল হলে কিংবা আগুনও যদি ধরে যায়, সেটা পাঁচ মিনিটের মধ্যে উদ্ধার হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। ১০০ সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। মুহূর্তের মধ্যেই সব তথ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছে যাবে। সংশয়ের কোনো কারণ নেই।’

বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টানেলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে, আমাদের ট্রান্সফরমার আছে, জেনারেটর আছে। জেনারেটরের সাহায্যে চলবে। এর মধ্যে ইউপিএসও আছে। কারেন্ট যদি চলে যায়, জেনারেটর চালু হতে যে সময়টুকু লাগবে সেই সময়টুকু ইউপিএস চালাবে। তার মানে টানেলের মধ্যে কেউ থাকা অবস্থায় যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, সে বুঝতেও পারবে না। এতটুকু বোঝা যাবে যে, আগে হয়তো ১০টি লাইট জ্বলতো, এখন চারটি লাইট জ্বলছে। এটা কিছু সময়ের জন্য। সেটা হতে পারে ১০ থেকে ২০ সেকেন্ডের জন্য।’

টানেলের ভেতরে মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মোবাইল নেটওয়ার্ক এখনও আছে। শুধু ৫০০ থেকে ৬০০ গজের মধ্যে একটু সমস্যা হয়। সেটাও সচল হয়ে যাবে।’

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/পিটিএম

ইতিহাস কর্ণফুলী নদী বঙ্গবন্ধু টানেল স্বপ্নযাত্রা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর