নদীর ভাঙনে বসতি সরালেও জন্মভূমিতেই শায়িত হলেন পারভেজ
২৯ অক্টোবর ২০২৩ ২১:৩২
মানিকগঞ্জ: যমুনার ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়েছেন কয়েক বছর আগে। এর পর টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার দপ্তিয়র ইউনিয়নের ফয়েজপুর গ্রামে বসতি গড়ে তুলেছে পুলিশ কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম পারভেজের পরিবার। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীদের হামলায় নিহত পারভেজ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন প্রিয় জন্মস্থান মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের মাটিতেই।
বোরবার (২৯ অক্টোবর) পারভেজের মরদেহ দৌলতপুর হাইস্কুল মাঠে আনার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন। লাশবাহী গাড়িটি মাঠে প্রবেশ করা মাত্রই পরিবারের সদস্যদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ।
এদিকে, তাকে হারিয়ে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্ত্রী, একমাত্র শিশুকন্যা এবং বৃদ্ধ বাবা-মা, ভাই-বোনের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের আর্তনাদ আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে এলাকাটি।
নিহত পুলিশ সদস্য পারভেজের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার চরকাঁটারী গ্রামে হলেও যমুনার ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে কয়েক বছর আগে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার দপ্তিয়র ইউনিয়নের ফয়েজপুর নামক গ্রামে বসতি গড়ে তুলেছেন।
তার বাবা সেকেন্দার আলী মোল্লা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মায়ের নাম রহিমা খাতুন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে মেঝ। বড় বোন শেফালী আক্তার। ছোট ভাই আজিজুল হক বিপ্লব এইচ এসসি পাশ করার পর থেকে বেকার। নিয়ত পুলিশ সদস্য পারভেজ তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলেন।
আরও পড়ুন:
- ফকিরাপুলে হামলায় পুলিশ সদস্য নিহত
- সংঘর্ষে নিহত পুলিশ সদস্যের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন
- মা, অনেক দিন বাড়িতে আসি না— ফেরা আর হলো না আমিরুলের
মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে ১০ মে চরকাটারী গ্রামে জন্ম নেওয়া আমিরুল স্থানীয় চরকাটারী সবুজ সেনা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট পুলিশ বিভাগে কনস্টেবল পদে যোগ দেন। চলতি বছরের ৩ আগস্ট থেকে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইনভেস্টিগেশন (সিটিআই–৩) ইউনিটে কর্মরত ছিলেন। কয়েক বছর আগে চরকাটারী এলাকায় আমিরুলের গ্রামের বাড়ি যমুনা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে। এরপর টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ফয়েজপুর গ্রামে বাড়ি করেন তারা। ওই বাড়িতে তার বাবা, মা ও ছোট ভাই থাকেন।
ঢাকায় কর্মস্থল হওয়ায় স্ত্রী রুমা আক্তার ও মেয়ে তানহাকে নিয়ে শাজাহানপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। শনিবার (২৮ অক্টোবর) বিকেলে ঢাকায় মহাসমাবেশ চলাকালে দায়িত্ব পালন করছিলেন পুলিশ কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম। দৈনিক বাংলার মোড় এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে বিএনপির নেতাকর্মীদের হামলায় আমিরুল গুরুতর আহত হন তিনি। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
পারভেজের ছোট ভাই আজিজুল হক বিপ্লব বলেন, ‘পারভেজই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। চাকরির সুবাদে ভাই পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। ২০১২ সালে তিনি বিয়ে করেন মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার হাতেম আলীর মেয়ে রুমা আক্তারকে। তাদের ঘরে ছয় বছর বয়সী তানহা ইসলাম নামে এক ফুটফটে কন্যা সন্তান রয়েছে। আমার ভাই একজন ভালো ও সাদাসিধে মানুষ ছিল। পুরো পরিবারের খরচ তিনি বহন করতেন।’
বড় বোন শেফালী আক্তারকে দেখা গেল ভাইয়ের জন্য মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছেন। শুধু আর্তনাদ করে বললেন, ‘আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।’
দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম রাজা বলেন, ‘পারভেজের মা, বাবা ও ভাই ফয়েজপুর গ্রামে বসবাস করলেও এখনো তারা দৌলতপুর এলাকার ভোটার। পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী পারভেজকে তার প্রিয় জন্মস্থান দৌলতপুরের মাটিতেই শায়িত করা হয়েছে। পারভেজকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতে দেখতে চাই।’
দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শফিকুল ইসলাম মোল্ল্যান বলেন, ‘ঢাকা থেকে পুলিশ সদস্য আমিনুল ইসলাম পারভেজের মরদেহ বিকেলে দৌলতপুর আনা হয়। দৌলতপুর হাই স্কুল মাঠে তার নামাজের জানাজা পর দাফন সম্পন্ন হয়।’
এদিকে, নিহত পুলিশ সদস্যের মরদেহ দৌলতপুর হাইস্কুল মাঠে আনার পর সেখানে ছুটে যান পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক সামাজিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষ। পুলিশ সদস্যর মরদেহ এক নজর দেখতে শত শত নারীরাও ছুটে আসেন সেখানে।
সারাবাংলা/পিটিএম