‘আমার বাচ্চাটা মা কই বলে খুঁজলেও ওরা দেখতে দেয়নি’
৩০ অক্টোবর ২০২৩ ২২:৫৩
ঢাকা: ১০ বছরের এমিলিয়া। ১১ অক্টোবর ছিল জন্মদিন। তিন দিন আগেও হেসেখেলে বেড়াচ্ছিল। গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে বাবার নতুন কর্মস্থল নোয়াখালী গিয়ে মা আর জমজ বোনের সঙ্গে মজাও করেছে। দুই দিন আগে হঠাৎ শরীর খারাপ হলে জরুরিভিত্তিতে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও ঠিকমতো চিকিৎসা না পাওয়ায় মেয়েটিকে নেওয়া হয় স্কয়ার হাসপাতালে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। এমিলিয়া পাড়ি দিয়েছে না ফেরার দেশে।
এমিলিয়ার পরিবারের অভিযোগ, স্কয়ার হাসপাতালে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা সঠিক চিকিৎসার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেই মেয়েটিকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এমনকি মেয়ের কাছে তার মাকেও যেতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।
মৃত এমিলিয়া মঞ্জুর রাজ চৌধুরী রাজধানীর হলিক্রস স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। তার মা নুরজাহান মঞ্জুর চৌধুরী একজন অনলাইন উদ্যোক্তা। বাবা নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং কলেজের উপঅধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হলের সরকারি পুলিশ কোয়ার্টারে পরিবারের সঙ্গে থাকত এমিলিয়া।
এমিলিয়ার পরিবার জানিয়েছে, গত শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) অসুস্থ হয়ে পড়লে এমিয়িলাকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। পুলিশ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল ঘুরে শনিবার তাকে ভর্তি করা হয় স্কয়ার হাসপাতালে। এর দুই দিনের মাথাতেই সব শেষ। সোমবার দুপুরেই এমিলিয়া ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। সেখান থেকে বিকেলে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় দাফনের জন্য।
সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নুরজাহান চৌধুরীর দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিওতে তিনি স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলায় তার মেয়ের মৃত্যুর অভিযোগ করেন। যোগাযোগ করলে সারাবাংলার কাছেও তিনি একই অভিযোগ করেছেন। পাশাপাশি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।
নুরজাহান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলায় আমার বাচ্চাটা মারা গেছে। এখানে ভর্তি করার পর চিকিৎসকেরা জানালেন, ওর শরীর সবখানে ইনফেকশন ছড়িয়ে গেছে। রক্তে ইনফেকশন বেশি বেড়ে যাওয়ায় কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই দুই কারণে ওর এত জ্বর উঠল যে ও ট্রমায় চলে গেল। তখন আমাকেও চিনতে পারছিল না। সকালে দেখি ওর সব নল খোলা। কিন্তু নল খোলার আগে আমাদের কোনো অনুমতিও নেওয়া হয়নি।
এমিলিয়ার অসুস্থতা থেকে শুরু করে পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তার মা বলেন, জন্মের সময়ই খাদ্যনালী ব্লক ছিল এমিলিয়ার। এর জন্য নিউইয়র্কে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। এরপর আর কোনো সমস্যা হয়নি। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে হঠাৎ তার আবার পেট ব্যথা ও বমি শুরু হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নেন তৎক্ষণাৎ। সমস্যা না কমলে সকালে হাসপাতালে নিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও এক্সরে করে জানা যায়, ফের খাদ্যনালী ব্লক হয়ে গেছে। এরপরই তাকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়।
নুরজাহান চৌধুরী বলেন, মিলুকে শনিবার স্কয়ারে নিয়ে আসি। তারা বলল, মেয়ের অবস্থা ক্রিটিক্যাল, তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরপর রোববার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বাচ্চাকে আমাদের দেখতে দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাচ্চা না দেখতে দিলেও অবস্থা জেনে আমাদের জানানোর জন্য নার্সকে বারবার বলেছি। তারা সেটিও করেনি। পরে ওদের প্রশাসনের একজনকে খুঁজে বের করে তার মাধ্যমে আমি ঢুকেছি। দেখি, আমার বাচ্চাটা কান্না করতেছে। বারবার বলছে, আমার মাকে এনে দাও, আমি মায়ের কাছে যাব। নার্সরা সেখানে ঘোরাফেরা করলেও কেউ কিছুই বলছিল না।
পরে রাতে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয় নুরজাহান চৌধুরীর। তারা জানান, ইনফেকশন কমলেই এমিলিয়ার সব চিকিৎসা শুরু হবে। নুরজাহান চৌধুরী বলেন, ‘রাতে ওর (এমিলিয়া) শরীর অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অথচ আমাদের কিছু বলেনি। সকালে গিয়ে দেখি, ও ট্রমায় চলে গেছে। ও আমাকেও চিনতে পারছিল না। বারবার মাকে ডাকছিল। অথচ আশপাশে কোনো নার্স ছিল না। নাকে নল ছিল না, হাতে ক্যানোলা ছিল না। স্যালাইন ছিল না। ও এমনিতেই পড়ে ছিল। আমরা ডেকে বলার পর তখন চিকিৎসক ওকে দেখতে গিয়েছে। তখন আমরা বলেছি, আমাদের বললে আমরা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশের বাইরে নিয়ে যাব। ওই সময় চিকিৎসক জানায়, তারা কাগজপত্র তৈরি করছে। কিন্তু তার আগেই বাচ্চাটা আমার আর নেই।
অভিযোগ করে নুরজাহান চৌধুরী বলেন, রাতে আমার মেয়েকে ওরা কোনো চিকিৎসা দেয়নি। তাই ওর অবস্থা এত খারাপ হয়ে যায়। তখন আমাদের কিছু না বলেই লাইফ সাপোর্টে দিয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা পর আমাকে জানায়, ‘আপনার বাচ্চা ইজ নো মোর।’ আমি বললাম, লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলতে হলে আমাকে তো ডাকতে হবে। আমাকে তো কেউ ডাকলেন না। এর কারণ কী? তারা কেউ আমাকে কোনো জবাব দেয়নি। শুধু ঘোষণা দিয়ে বলল, বাচ্চা আর নেই। আমরা যেন নিয়ে যাই। ওদের অনেক গাফিলতি ছিল। ডাক্তার কাদেরের তত্ত্বাবধানে ছিল রোগী, কিন্তু সেই ডাক্তার রোগীর কাছে ছিলেন না। নার্সরাও কেউ আমার মেয়ের আশপাশে ছিলেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্কয়ার হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী মো. ইউসুফ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাচ্চার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আমাদের ডাক্তাররা খুব চেষ্টা করেছেন। তাদের কোনো গাফিলতি নেই। বাচ্চাটি ছিল আইসিইউতে। সেখানে আরও ৩০টির মতো রোগী আছে। তার মা খুব চিৎকার চেঁচামেচি করছিলেন। তাই অন্য রোগীদের কথা চিন্তা করে তাকে আমরা আইসিইউতে রাখার অনুমতি দেইনি। সেখানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডিআইজি, অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ছিলেন। তারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। তারাই শিশুর স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়ে নিয়ে গেছেন।’
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
চিকিৎসায় অবহেলা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ শিশু এমিলিয়া স্কয়ার হাসপাতাল