অবরোধে সচল চট্টগ্রাম বন্দর, পণ্য পরিবহন ‘কিছুটা’ কমেছে
১ নভেম্বর ২০২৩ ২১:২৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য উঠানামায় এখনও প্রভাব পড়েনি। জাহাজ থেকে আমদানি পণ্য খালাস ও রফতানি পণ্য জাহাজীকরণ প্রায় স্বাভাবিক আছে। তবে খালাস হওয়া পণ্য পরিবহনে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। অবরোধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবোঝাই ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ ভারি যানবাহন চলাচল কমে গিয়ে বন্দরের কার্যক্রমে এর প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থা তৈরি হলে ভোগ্যপণ্যের বাজারেও প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া কাঁচামাল নিয়ে সংকট তৈরি হতে পারে রফতানিমুখী শিল্প কারখানাগুলোতেও। পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, অবরোধের কারণে পণ্য পরিবহনের ভাড়াও বাড়তে শুরু করেছে।
সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি শুরু করেছে বিএনপি, সঙ্গী হয়েছে জামায়াতও। গত ২৯ অক্টোবর সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পর ৩১ অক্টোবর থেকে ৭২ ঘণ্টার লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে আরও কর্মসূচি আসবে, এমন আভাস দিয়ে রেখেছেন বিএনপির নেতারা। অবরোধের মধ্যে চট্টগ্রামে পণ্যবাহী লরি, যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের মধ্যে পণ্যবাহী পরিবহন রাস্তায় নামানো নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে। চট্টগ্রাম থেকে পণ্য নিয়ে পরিবহন দেশের অন্যান্য গন্তব্যে যাওয়া কিছুটা কমেছে। তবে সেটা এখনও বড় আকারে প্রভাব তৈরি করতে পারেনি বলে মনে করছেন পরিবহন মালিকরা।
বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান-ট্রাক পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সুফিউর রহমান টিপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আপাতত পণ্য পরিবহনে তেমন কোনো সংকট নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস হয়েছে, কিন্তু গাড়ির অভাবে বাইরে নেয়া যাচ্ছে না এমন কোনো পণ্য নেই। ২৪ ঘণ্টা বন্দরে গাড়ি পণ্য নিয়ে আসা-যাওয়া করছে। দিনে ৭ থেকে ৮ হাজার গাড়ি পণ্য পরিবহন করে। এটা সেভাবে কমেনি। তবে অবরোধ অব্যাহত থাকলে সংকট হতে পারে। কারণ, আতঙ্ক নিয়ে তো আর গাড়ি চালানো যায় না।’
বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবরোধের মধ্যেও মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) বন্দরের বিভিন্ন জেটিতে ১৮টি জাহাজে পণ্য ওঠানামা হয়েছে। এদিন প্রায় তিন হাজার টিইউস কনটেইনার বন্দর থেকে বের হয়েছে। অবরোধের আগেরদিন সোমবার এর চেয়ে এক হাজার টিইউস বেশি কনটেইনার পরিবহন হয়েছে।
অবরোধের মধ্যে গত দু’দিন সকালে বন্দরে ট্রাক, ট্রেইলার ও কাভার্ডভ্যান স্বাভাবিকের চেয়ে কম প্রবেশ করেছে। তবে বিকেল গড়াতেই পণ্যবাহী পরিবহনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে দু’দিনই পণ্য সরবরাহ তুলনামূলক কম হয়েছে বলে বন্দরের কর্মকর্তারা জানান।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবরোধ চললেও চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস স্বাভাবিক আছে। রফতানি পণ্যও আসছে এবং স্বাভাবিকভাবে জাহাজে লোড হচ্ছে। অবরোধের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সকালের দিকে একটু গাড়ির চাপ কম থাকে। ডেলিভারি কিছুটা কম হলেও একদম কমে গেছে সেটা বলা যাবে না।’
এদিকে অবরোধের মধ্যেও বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলোতে পণ্য হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক আছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং কিছুটা কম হলেও রফতানি স্বাভাবিক রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ১ থেকে ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপো আছে। এসব ডিপোতে শতভাগ রফতানি পণ্য কনটেইনার বোঝাই করে জাহাজীকরণের জন্য বন্দরে নেওয়া হয়। এছাড়া খাদ্যপণ্যসহ ৩৭ ধরনের আমদনি পণ্য জাহাজ থেকে বন্দরে নামানোর জন্য সেগুলো ডিপোতে এনে খালাস করা হয়।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সচিব রুহুল আমিন শিকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবরোধের কোনো প্রভাব ডিপোগুলোতে পড়েনি। গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৭৮১ টিউইস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৮১ টিইউস কনটেইনার রফতানি ও ৬০৫ টিইউস কনটেইনার আমদানি করা হয়েছে, যার মধ্যে ১ হাজার ২৪টি জাহাজীকরণ করা হয়েছে। আমদানি কম। কারণ আমদানিকারকরা আশঙ্কায় আছে। তারা কোনো ঝুঁকি হয়ত নিতে চাচ্ছেন না। তবে সব মিলিয়ে অবস্থা স্বাভাবিক।’
দাম বাড়তে পারে পণ্যের
লাগাতার অবরোধের কারণে পণ্য বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ীরা।
তারা জানান, অবরোধের কারণে গাড়ি কম চলায় ভাড়া বেশি গুণতে হচ্ছে। গাড়ির মালিকরা রাস্তায় গাড়ি বের করতে ভয় পাচ্ছেন। যারা বের করছেন তারা দ্বিগুণ ভাড়া দাবি করছেন। আবার বাজারে ক্রেতার সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবরোধেও খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাট খুলেছে। তবে ক্রেতা কম। পণ্যের দামও স্বাভাবিক আছে। শুধু পেঁয়াজের দাম একটু বাড়তি। সেটা অবশ্য অবরোধের জন্য না। ভারত শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ায় দাম বেড়েছে। ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ পাইকারিতে কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়, যেটা আগে ছিল ৯০-৯৫ টাকায়। আর দেশি পেঁয়াজ ১২০ টাকায়।’
রেয়াজউদ্দিন বাজার আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক শিবলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবরোধের কারণ প্রতিটি গাড়ি ভাড়া দ্বিগুণ করেছে। সবজিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবে বাড়বে।’
পোশাক শিল্পেও কিছু শঙ্কা
অবরোধের কারণে পণ্য পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র কর্মকর্তারা। তবে এ মুহূর্তে শ্রমিকদের নিরাপদ যাতায়াতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা, যাতে কারখানা সচল থাকে।
বিজিএমইএ’র চট্টগ্রামের পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সবকিছু ভালো ও স্মুথলি চলছে। তবে আমরা আশঙ্কায় আছি। কয়েকবছর আগেও একইভাবে হরতাল-অবরোধ হয়েছিল। তখন আমরা পোশাক শ্রমিকদের বহনকারী যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা দেখেছি। এবারও পোশাক শ্রমিকদের গাড়ি টার্গেট করে আগুন দেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে তাদের জানমাল নিয়ে আমাদের শঙ্কা আছে। তারা নিরাপদে কর্মস্থলে যেতে না পারলে কারখানা সচল থাকবে না।’
‘অবরোধের কারণে স্বাভাবিকভাবেই রফতানি পণ্য ও কাঁচামাল পরিবহনে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। গাড়ির মালিকরা ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি বের করতে চান না। আবার অবরোধকে অজুহাত করে দুই-তিনগুণ বাড়তি ভাড়া দাবি করছে। এতে আমাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে’, বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি/এমও