আলো ও সুঘ্রাণে প্রাণে প্রাণে ‘মঙ্গলবারতা’ আবাহন
২ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:০৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: শেষ বিকেলের সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে। আকাশজুড়ে বিদায়ী সূর্যের লালচে আভা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটার রাণী জপমালা গির্জার কবরস্থানে তখন আলোর সমাহার। কবরে-কবরে জ্বলে উঠেছে মোমবাতি। আগরবাতির সুঘ্রাণে মোহময় চারদিক। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে হাজারো কবর।
বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) বিশ্বজুড়ে পালিত ‘অল সোলস ডে’ উপলক্ষে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গির্জায় মোমবাতি প্রজ্বলন করেছেন অনন্তলোকের সওয়ারী খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষগুলোর পুণ্যপ্রার্থী স্বজনেরা। তারা প্রয়াতদের সমাধিতে ফুল ছিটিয়েছেন, প্রার্থনায়ও শরিক হয়েছেন।
এবারও চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় সমাগম হয়েছে নগরীর পাথরঘাটায় রাণী জপমালা গির্জার কবরস্থানে। শোকার্ত সমবেত মানুষগুলো সকাতরে আর্তি জানিয়েছেন যেন এ পৃথিবী থেকে তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনেরা ঈশ্বরের কৃপায় মুক্তি পেয়ে স্বর্গবাসী হন। প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতার সকরুণ আবাহন ছিল তাদের কণ্ঠে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আর্চডায়োসিসের পালকীয় সমন্বয়কারী মানিক উইলভার ডি কস্তা সারাবাংলাকে জানান, চট্টগ্রামের বৃহত্তম এই গির্জায় শোক ও প্রার্থনা সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এতে পৌরহিত্য করেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার।
আর্চবিশপকে সহযোগিতা করেন চট্টগ্রাম আর্চডায়োসিসের ভিকার জেনারেল টেরেন্স রড্রিক্স, জপমালা রাণী ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত রিগান ক্লেমেন্ট ডি’কস্তা, চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের অর্থ ও প্রশাসনিক পরিচালক পঙ্কজ ইগ্নেশিয়াস পেরেরা, জপমালা রাণী ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর সহকারী পাল-পুরোহিত পিন্টু বেঞ্জামিন কস্তা এবং যিশু হৃদয় সেমিনারি আলীকদমের রেক্টর সজল আন্তনী কস্তা।
সমবেতদের উদ্দেশে আর্চবিশপ সুব্রত হাওলাদার বলেন, ‘প্রতিবছর ২ নভেম্বর আমরা কবরস্থানে আসি, কবর সাজাই, মোম জ্বালাই। তবে সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৃত আত্মীয়স্বজনের আত্মার জন্য প্রার্থনা করা, তাদের নামে জগতে মঙ্গল কাজ করা। আজ পূণ্যভূমিতে, যে মাটিতে আমাদের প্রিয়জনেরা শায়িত আছেন, সে মাটিতে দাঁড়িয়ে পরমপিতাকে প্রণতি জানাই যেন তুমি তাদের মাঝ থেকে মৃত্যুর অন্ধকার দূর করে দাও। এই আলো অনন্তশিখার মতো আমাদের অন্তরে প্রজ্বলিত থাকুক।’
‘আমাদের বিশ্বাস এই অনির্বাণ আলোকশিখার দীপ্ত আগুনে কবরে শায়িত আমাদের প্রিয়জনেরা শুদ্ধ হয়ে তোমার সান্নিধ্য লাভ করবে। তুমি মৃত্যুঞ্জয় রূপে যুগে যুগে বিরাজমান হও হে প্রভু। হে জীবনময় পরমেশ্বর, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, তুমি আমাদের সকলকে আশীর্বাদ করো।’
ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লির সদস্য এমরোজ গোমেজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্যাথলিক খ্রিষ্টরা বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মা জাগতিক দুর্বলতার জন্য পরিশোধিত হয়। এই সাময়িক শোধনের স্থান হচ্ছে শুচ্যাগ্নিস্থান। অর্থাৎ স্বর্গ আর নরকের মাঝামাঝি স্থান। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আমাদের মৃত স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা দ্রুত মাঝামাঝি স্থান থেকে ঈশ্বর তাদের স্বর্গধামে গ্রহণ করবেন। তাদের আত্মার মুক্তি কামনায় আমরা আলো প্রজ্বলন করেছি আর ফুল হচ্ছে আমাদের অন্তরের উপহার।’
রাণী জপমালা গির্জার কবরে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর কেউ বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্য, কেউ প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হারিয়েছেন। স্বজনদের সঙ্গে তারা তাদের জন্যও প্রার্থনায় শরীক হয়েছেন যারা এ পৃথিবীতে প্রার্থনা করার জন্য কাউকে রেখে যেতে পারেননি।
জিতা রেমা নামে এক নারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসীরা মনে করি, যারা তাদের জীবনকে সুন্দরভাবে পূণ্যময়তা দিয়ে যাপন করে গেছেন, তারা নিশ্চিতভাবেই স্বর্গে চলে গেছেন। আর যারা নানা কারণে পাপমুক্ত জীবন যাপন করতে পারেননি, তারা পরিশুদ্ধতার জন্য স্বর্গে যেতে পারেননি। আমরা প্রার্থনা করেছি, মহান ঈশ্বর আমাদের এই যে প্রার্থনা সেটা গ্রহণ করে তাদের যেন স্বর্গে স্থান দেন। আমরা শুধু আমাদের স্বজনদের জন্য প্রার্থনা করিনি, যাদের কেউ নেই, তাদের মৃত আত্মার জন্যও করেছি।’
ফাদার রিগ্যান ডি কস্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য আজ একটি বিশেষ দিন। এদিন আমরা তাদের আত্মার শান্তি কামনায় মহাপ্রার্থনা করেছি। তাদের আত্মা যেন স্বর্গসুখ লাভ করে, সেই প্রার্থনা করেছি। তারা যেন অনন্তলোকে প্রভু যিশুর সান্নিধ্য পান, সেই প্রার্থনা করেছি। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষার আকুতিও জানানো হয়েছে মহান ঈশ্বরের কাছে।’
রাজনৈতিক অবরোধ কর্মসূচির কারণে এবার দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে আবার স্বজনের কবরে আসতেও পারেননি। কারিতাস, বাংলাদেশ পরিচালিত মিরপুর এগ্রিকালচারাল ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং স্কুলের (মটস) পরিচালক জেমস গোমেজের বাবা ও বোনের কবর পাথরঘাটার রাণী জপমালা গির্জায়। প্রতিবছর ঢাকা থেকে তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে আসেন। কিন্তু এবার অবরোধের কারণে ঢাকা ছাড়তে পারেননি।
জেমস গোমেজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সড়কপথে দূরপাল্লার বাস তেমন ছাড়ছে না। সেজন্য এবার সব প্রস্তুতি নিয়ে শেষমুহুর্তে আসতে পারিনি। দূরে বসেই এবার বাবাসহ সকল স্বজনের জন্য অনন্তলোকের পাশাপাশি নিজেদের পূণ্যময় জীবন কামনায় প্রার্থনা করেছি।’
তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আর্চডায়োসিসের পালকীয় সমন্বয়কারী মানিক উইলভার ডি কস্তা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, অবরোধের মধ্যেও গির্জায় প্রতি বছরের মতো ব্যাপক পূণ্যার্থীর সমাগম হয়েছে।
এদিকে, প্রার্থনা শেষে খ্রিষ্ট ভক্তদের জন্য খ্রিষ্টপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। ‘অল সোলস ডে’ উপলক্ষে নগরীর বিভিন্ন গির্জায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম