ক্যাম্প ছেড়ে শহরে এসে ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শিশুরা, দেখার নেই কেউ!
৪ নভেম্বর ২০২৩ ১০:২৪
কক্সবাজার: কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা পয়েন্টে এলাকার ট্যুরিস্ট পুলিশ বক্সের পাশে ফুটপাতের ওপর আড্ডা দিচ্ছিল ১০ থেকে ১২টি পথশিশু। তাদের প্রায় সবার পরনেই নোংরা, মলিন পোশাক। চেহারাতেও নেই পরিবারের যত্নের ছাপ। একসময় চোখে পড়ে একটি শিশুর বাম হাতের কবজি থেকে বেশ কিছু অংশ পোড়া। দুটি আঙুল বেঁকে আছে অস্বাভাবিকভাবে। কীভাবে এমন হলো— জানতে চাইলে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ্ (ছদ্মনাম) নিজের হাত পোড়ার গল্প জুড়ে দেয়।
কক্সবাজার শহরে দেখা হলেও আব্দুল্লাহ মূলত রোহিঙ্গা শিশু। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছে শহরে। শিশুটি জানায়, ছয় মাস আগে ডিশ লাইনের ক্যাবল (তার) মনে করে বৈদ্যুতিক তারে টান দেওয়াও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় সে। কপাল জোরে বেঁচে গেলেও হাতটা পুড়ে গেছে।
বলতে বলতে আনমনা হয়ে যায় আব্দুল্লাহ। তার হাতে পোড়ার ক্ষত স্পষ্ট দৃশ্যমান, কিন্তু তার কপালও যে বহু দিন আগে পুড়েছে। আব্দুল্লাহর অস্ফূট স্বগতোক্তিকেও আক্ষেপ— তার পোড়া কপাল দেখেও দেখার কেউ নেই!
আব্দুল্লাহ এখন কক্সবাজার শহরে অন্য ভাসমান শিশুদের সঙ্গে থাকে। ফুটপাতে কিংবা রাস্তার ওপরেই কাটে তার দিন। তার মতো আরও অনেক রোহিঙ্গা শিশুই ক্যাম্প ছেড়ে কক্সবাজার শহরে এসে আশ্রয় খুঁজছে। ওই আড্ডাতেই উপস্থিত ১০/১২ জনের মধ্যে সাতজনই ছিল রোহিঙ্গা। তাদের প্রত্যেকেই ক্যাম্প থেকে পালিয়েছে।
আব্দুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের মতো ক্যাম্প থেকে পালানো রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষেরই কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। জেলা প্রশাসন ও পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এ বিষয়টি নিয়ে নির্বিকার। দেখেও যেন তারা দেখছেন না কিছুই। শহরের বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের ঘুরে বেড়াতে দেখা গেলেও উদ্বেগহীন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনও।
কেন ক্যাম্প থেকে পালিয়েছে— জানাতে চাইলে রোহিঙ্গা শিশুরা জানাচ্ছে, ক্যাম্পের বন্দি জীবন তারা মেনে নিতে পারছে না। পাশাপাশি পরিবারের অভাব-অনটনও রয়েছে। এসব কারণই ঘরহারাদের দলে নাম লেখাতে বাধ্য করেছে বলে জানাচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আশপাশে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একাধিক ধাপে রয়েছে চেকপোস্ট। সবকিছু ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্প থেকে কীভাবে পালায় তারা— এমন প্রশ্নের উত্তরে শিশুরা বলল, ‘আগে সমস্যা হলেও এখন কোনো ব্যাপার না। স্থানীয়দের মতো পোশাক, কথাবার্তা আর চলাচল করতে পারলেই চেকপোস্ট ফাঁকি দেওয়া যায়। ধরা পড়লে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাদের। পরে আবার চেষ্টা করে চলে আসা যায়।’
১২ বছরের করিম উল্লাহ (ছদ্মনাম) জানায়, দুই বছর আগে চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা পরিবারের কাছ থেকে পালিয়ে শহরে আসে সে। রোহিঙ্গা বন্ধুর সহযোগিতায় পালিয়ে এসে যুক্ত হয় শহরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে। প্রথম কিছুদিন খারাপ লাগলেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে তার ভবঘুরে জীবন। প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে দিন কাটছে তার।
ক্যাম্প থেকে আসার তিন মাস পর শহরের গাড়ির মাঠ এলাকার এক চায়ের দোকানে কাজ পায় করিম উল্লাহ। কাজের সময় খেলতে যাওয়ার অভিযোগে দিন বিশেক পর সেখান থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। এখন রাস্তাতেই দিনরাত কাটে করিম উল্লাহর। দিনে ভাঙারি কুড়িয়ে বিক্রি করে খাবারের টাকা জোগাড় করে গভীর রাতে ক্লান্ত শরীরে অন্য শিশুদের সঙ্গে ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা এই শিশুদের সবাইকেই শহরে এসে ভাসমান জীবন বেছে নিতে হচ্ছে। ক্যাম্পে বন্দি জীবন হলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল। কক্সবাজার শহরে সেই ন্যূনতম আশ্রয় থেকেও বঞ্চিত তারা। উল্টো পথশিশু হিসেবে প্রতিনিয়ত অবহেলা আর মারধরের শিকার হতে হয় তাদের। এমনকি জীবনের কোনো নিরাপত্তাও তাদের নেই। ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সুগন্ধা পয়েন্টের নালায় পর্যটকের পড়ে যাওয়া মোবাইল তুলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছিল।
আব্দুল আলিম নামে আরেক রোহিঙ্গা শিশু জানায়, নাজিরারটেকে অনেক আগে থেকেই তাদের পরিচিত এক রোহিঙ্গা পরিবারের বসবাস। ৯ মাস আগে সেই আত্মীয়ের মাধ্যমে সেও চলে আসে শহরে। শুঁটকি পল্লীতে কাজে নিয়োজিত করা হয় তাকে। শুরুর দিকে ভালো ব্যবহার পেলেও পরে তাকে ঘর থেকে বের করে দেয় শুঁটকি পল্লীর মালিক। এক বেলা খেতে দিয়ে আরেক বেলা দেয় না। এরকম কয়েক মাস যাওয়ার পর আলিম শুঁটকি পল্লী থেকে চলে আসে। এখন সে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে থাকছে, যেখানে তার পরিচিত রোহিঙ্গা শিশুরাও আছে।
আব্দুল আলিম বলল, ‘মাসখানেক আগে এক মাতাল ছিনতাইকারী আমার কাছে থাকা ১০০ টাকা ছিনিয়ে নেয়। আমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। হাত ও পিঠ মারাত্মকভাবে জখম হয়। এরপর থেকে ভাঙারি কুড়াতেও অসুবিধা হয়।’ এ পরিস্থিতিতে এখন পর্যটকদের কাছে ভিক্ষা করেও খাবারের টাকা জোগাড় করছে আব্দুল আলিম।
এত কষ্ট করে পথশিশুদের সঙ্গে থাকছে কেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে আলিম বলে, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এরকম ভাঙারি কুড়ানোর সুযোগ নেই। কাজ করে টাকা আয়ের উপায় নেই। তাই কষ্ট হলেও এখানেই ভালো লাগে।’
কক্সবাজার শহরে ভাসমান হিসেবে আশ্রয় নেওয়া আব্দুল্লাহ, করিম উল্লাহ ও আব্দুল আলিমের মতো রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা গুনে শেষ করার মতো না। কক্সবাজার শহরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে কাজ করা ‘নতুন জীবন’ সংগঠনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শহরে থাকা পথশিশুদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই রোহিঙ্গা শিশু। তারা প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে পড়ছে। থাকা-খাওয়ার অনিশ্চিয়তার পাশাপাশি অসুস্থ হচ্ছে। পড়ছে নানা ধরনের দুর্ঘটনায়।
নতুন জীবন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুমন শর্মা বলেন, কক্সবাজার শহরে আড়াই শর বেশি সুবিধাবঞ্চিত শিশু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় এক শ জনই রোহিঙ্গা শিশু। তাদের রাত্রীযাপন যেমন অনিশ্চিত, তেমনি নেই খাবারের নিশ্চয়তাও।
নতুন জীবনের তথ্য বলছে, শহরের কলাতলী, সুগন্ধা পয়েন্ট, গাড়ির মাছ, সমিতি পাড়া, পেশকার পাড়া ও কবিতা চত্বর এলাকায় পথশিশুদের অবস্থান বেশি। তাদের রাত কাটে ফুটপাত, মার্কেটের বারান্দা ও ভাঙারির দোকানে। খাবারের টাকা জোগাড় করতে তারা ভাঙারি কুড়ায়, কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তিও করে।
সুমন শর্মা বলেন, এসব রোহিঙ্গা শিশুরা সার্বক্ষণিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। ভাঙারি ব্যবসায়ীরা ওজনে কম দিয়ে এবং টাকা না দিয়ে তাদের ঠকাচ্ছে। অসুস্থতা, দুর্ঘটনা ও হামলার শিকারও হচ্ছে তারা। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা এসব শিশুদের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
কক্সবাজার শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুর্নবাসন কেন্দ্রের উপপ্রকল্প পরিচালক জেসমিন আকতার বলেন, ‘অনেক সংগঠন রোহিঙ্গা পথশিশুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমাদের পুর্নবাসন কেন্দ্রে পাঠায়। কিন্তু আমাদের এখানে রোহিঙ্গা শিশুদের রাখার নিয়ম নেই। রোহিঙ্গা শিশুদের ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগে, কিন্তু আমাদের কিছু করার থাকে না। এই কোমলমতি শিশুদের নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে।’
জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ (সার্বিক) বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিশুদের ক্যাম্প ছেড়ে আসার জরিপ আমাদের কাছে নেই। তবে কোমলমতি শিশুদের ক্যাম্প ছেড়ে আসটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে সার্বিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে যেন শিশুরা নিরাপদে থাকে।’
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে। যেসব শিশু এরই মধ্যে চলে এসেছে, তাদের খুঁজে বের করে নিরাপদে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো দরকার। শুধু রোহিঙ্গা শিশু নয়, সব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সার্বিক সমস্যা সমাধানে প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অবশ্যই মর্যাদাপূর্ণ টেকসই হতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
সারাবাংলা/এনইউ
ক্যাম্প থেকে পালানো ঝুঁকি ঝুঁকিপূর্ণ জীবন পথশিশু রোহিঙ্গা রোহিঙ্গা ক্যাম্প রোহিঙ্গা শিশু