শোকের আয়োজনে যাচ্ছিল, তাদের জন্যই এখন ‘শোকের মাতম’
৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৪৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১১ দিন আগে মারা যাওয়া ঠাকুরমা (দাদী) কনকলতা দাশের আদ্যশ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন গৃহবধূ রীতা দাশ। সঙ্গে ছিল চার সন্তান, নিকটাত্মীয়সহ আট জন। এর মধ্যে সাতজনেরই প্রাণ গেল সড়কে। এক শোকের আয়োজনের মধ্যেই চেপে বসল সাতটি প্রাণ হারানোর মর্মন্তুদ ব্যাথা।
রীতা’র বাবা মায়ের শ্রাদ্ধ করতে বসেছিলেন। চলছিল শত লোকের খাওয়ার আয়োজন। এর মধ্যেই পেলেন মেয়ে, নাতি-নাতনীদের মৃত্যুর খবর। তখন শ্রাদ্ধ রেখেই ছুটলেন স্বজনরা। সাতটি নিথর শরীর সামনে রেখে তাদের আহাজারি যেন আর থামে না!
মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) সকাল সোয়া ১১টার দিকে হাটহাজারী উপজেলার চারিয়া ইজতেমা মাঠ এলাকায় চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কে বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে সাত জন নিহত হন।
স্থানীয় নাজিরহাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক আদিল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামমুখী পদক্ষেপ পরিবহনের বাস এবং হাটহাজারী নতুনপাড়া থেকে যাত্রীবাহী অটোরিকশা ফটিকছড়ির দিকে যাচ্ছিল। মুখোমুখি সংঘর্ষে সাত জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আমরা বাসটি আটক করেছি। চালক ও সহকারী পালিয়ে গেছে। পরিবারের আবেদন অনুযায়ী, লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। হাটহাজারী থানায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।’
দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন- রীতা দাশ (৩৪) ও তার সন্তান শ্রাবন্তী দাশ (১৭), বর্ষা দাশ (১০), ৪ বছর বয়সী যমজ দুই ছেলে দিগন্ত ও দীপ এবং ভাসুরের ছেলে বিপ্লব দাশ (২৬) ও চাচাতো ননদ চিনু দাশ (৫০)।
স্বজনদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রীতা’র স্বামী নারায়ণ দাশ ওমান প্রবাসী। নারায়ণের বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার জোয়ারা ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে। তাদের বড় মেয়ে শ্রাবন্তী বাক প্রতিবন্ধী, এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। বর্ষা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।
একই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দু’জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এরা হলেন- চিনু দাশের ছেলে বাপ্পা দাশ (৩০) ও অটোরিকশা চালক বিপ্লব মজুমদার (২৮)। বাপ্পাদের বাড়ি চন্দনাইশের সাতবাড়িয়া এবং বিপ্লবের বাড়ি ফটিকছড়ির বারমাসিয়া এলাকায়।
রীতা দাশের বাবা মিলন দাশ ফটিকছড়ি উপজেলার শাহনগর ইউনিয়নের বণিকপাড়া এলাকার বাসিন্দা। রীতা ছাড়া তার আরও দুই মেয়ে, দুই ছেলে আছে।
আরও পড়ুন: বাসের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল অটোরিকশা, ৭ যাত্রীর সবাই নিহত
নারায়ণের বড় ভাই বাবুল দাশ সারাবাংলাকে জানান, সকাল ৭টায় রীতা চার সন্তানকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। বাড়ি থেকেই একটি অটোরিকশায় করে প্রথমে শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণপ্রান্ত মইজ্যারটেকে আসেন। বাড়ির অদূরে চন্দনাইশের বাদামতল এলাকা থেকে তাদের সঙ্গী হন চিনু ও তার ছেলে বাপ্পা। মইজ্যারটেক যাওয়ার পর বাবুলের মেঝো ভাইয়ের ছেলে বিপ্লব তাদের সঙ্গে যোগ দেন। নগরীর ব্রিজঘাটা এলাকায় নিজের লন্ড্রি দোকান থেকে সরাসরি বিপ্লব মইজ্যারটেকে যান।
মইজ্যারটেক থেকে আরেকটি অটোরিকশায় তারা যান হাটহাজারীর নতুনপাড়া এলাকায়। সেখানে তাদের জন্য অটোরিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন রীতা’র বাবার সম্পর্কের আত্মীয় চালক বিপ্লব মজুমদার। সেই অটোরিকশায় আট জন উঠে ফটিকছড়ির শাহনগরে যাওয়ার পথে চারিয়ায় দুর্ঘটনা ঘটে।
চারিয়া থেকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে হাটহাজারী থানার সামনে জেলা পরিষদ মিলনায়তনের সামনের বারান্দায় রাখেন। মঙ্গলবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, লাশের সারি সামনে রেখে আহাজারি করছেন স্বজনরা। ফটিকছড়িতে রীতা’র বাবার বাড়ি থেকে খবর পেয়ে তার মা-বোনসহ নিকটাত্মীয়রা গেছেন সেখানে। চন্দনাইশ থেকে রীতার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও সেখানে গেছেন।
লাশের অদূরে বসেছিলেন রীতার মা ছবি দাশ ও মাসতুতো বোন লিখি চন্দ। মেয়ে, নাতি-নাতনিদের হারিয়ে শোকে আকুল মা যেন কান্নার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন! চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে আবার নির্বাক হয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ!
কান্নাজড়িত কন্ঠে লিখিকে মোবাইলে কাকে যেন বলতে শোনা যায়, ‘তোঁয়ারা ন আইস্যো। এডে চনর মত কিছু নাই। মাথার খুলি-টুলি বেয়াগ্গিন ফাডি গিইয়ে। চেয়ারা কিছু বুঝা ন যার।’ (তোমরা এসো না। এখানে দেখার মতো কিছু নেই। মাথার হাড়গোড়ও ভেঙ্গে গেছে। চেহারা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।)
ছবি দাশ সারাবাংলাকে জানান, তার তিন মেয়ে, দুই ছেলের মধ্যে রীতা ছিল সবার বড়। গতবছর দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরদিন তার ছেলের বিয়ে ছিল। ভাইয়ের বিয়েতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে রীতা বাবার বাড়ি গিয়েছিলেন। তখনই মেয়ের সঙ্গে শেষ দেখা। গত একবছরে রীতা আর বাবার বাড়ি যাননি। শেষবার যেতে গিয়ে দুনিয়া ছেড়েই চলে গেলেন।
তিনি বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) আমি ফোন করেছিলাম- তোর ঠাকুরমার ক্রিয়া, সবাই এসে গেছে, তুই তাড়াতাড়ি আয়। সে বলল- আমি কাল (মঙ্গলবার) আসব মা। সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ফোন করে বলল- মা আমি আসছি। এটাই শেষ কথা।’
ছেলে-মেয়েসহ বোনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ছুটে যান রীতার দুই বোনও। ছোট বোন দিয়া দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আর আমার মেঝোবোন একদিন আগে গতকালই (সোমবার) বাবার বাড়িতে গেছি। ছোট যমজ দুই ছেলে, বড় মেয়েটা বাক প্রতিবন্ধী, এসব ঝামেলায় আমার বোন কোথাও আগে-ভাগে যেতে চান না। আজ (মঙ্গলবার) সকাল থেকে বোনের অপেক্ষায় ছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ক্রিয়া করতে বসেছেন মাত্র। সাড়ে ১১টার দিকে খবর আসে যে, অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমার বাবা শুনেছেন, কিন্তু তিনি তো আর শ্রাদ্ধের কাজ ফেলে উঠতে পারেননি। আমরা খবর পাওয়ামাত্র ছুটে এসেছি। এতবড় একটা ঘটনা, একটা পুরো পরিবার চলে গেল! কীভাবে মনকে বোঝাতাম!’
মেঝো বোন রুনু দাশ জানালেন, দুর্ঘটনার খবর ওমানে থাকা তাদের ভগ্নিপতি নারায়ণ দাশের কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি দ্রুত দেশে ফিরছেন বলে তাদের জানিয়েছেন।
বাবুল দাশ জানালেন, পরিবারের সিদ্ধান্তে ময়নাতদন্ত ছাড়াই রীতা ও তার চার সন্তান এবং বিপ্লবের লাশ তাদের বাড়িতে নেওয়া হচ্ছে। চিনু’র লাশ সাতবাড়িয়ায় তাদের বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে। সেখানেই তাদের দাহ করা হবে।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম