পতেঙ্গা টার্মিনাল চালাবে সৌদি প্রতিষ্ঠান, উদ্বোধন মঙ্গলবার
১০ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:৫১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশি না কি বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে— এ সংক্রান্ত জটিলতায় প্রায় দেড় বছর ধরে অলস পড়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে নির্মিত ‘পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল’। অবশেষে সেই টার্মিনাল আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, সৌদি আরবের একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে টার্মিনালটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন আগামী মঙ্গলবার। এ টার্মিনাল চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দর ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের (পানির নিচে জাহাজের গভীরতা) জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা অর্জন করবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবের ‘রেড সি গেটওয়ে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ হয়েছে আগামী মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর)। সেদিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টার্মিনালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এর আগে-পরে সৌদি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্নের তোড়জোড় চলছে বলে জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের পরই আমরা এটিকে পূর্ণাঙ্গ অপারেশনে নিয়ে যাব। সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ের সঙ্গে আমাদের আলোচনা (নেগোসিয়েশন) হয়ে গেছে। উদ্বোধনের আগে চুক্তি হয়ে যেতে পারে কিংবা উদ্বোধনের পরেও যেকোনো সময় হতে পারে। কিন্তু রেড সি গেটওয়ে যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল অপারেট করবে, এটি ফাইনাল হয়ে গেছে।’
জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটি টার্মিনালটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এবং দুই দেশের সরকারের মধ্যে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব (জি-টু-জি) চুক্তির আওতায় পরিচালনার বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়।
ওই বছরের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ও সৌদি সরকারের প্রতিনিধিদলের এক ব্যবসায়িক সভায় পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। সৌদি সরকার রেড সি গেটওয়েকে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করে। প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে মনোনয়নও দেওয়া হয়। ২৮ অক্টোবর সৌদি সরকারের বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পিপিপি কর্তৃপক্ষের সমঝোতা স্মারক সই হয়।
চলতি বছরের ১১ মার্চ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রেড সি গেটওয়ের ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সই হয়। ২৪ জুলাই রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড টার্মিনাল পরিচালনার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। পিপিপি কর্তৃপক্ষ সৌদি সরকারের প্রস্তাবের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে।
এরপর গত ৫ অক্টোবর পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের বিষয়ে সৌদি সরকারের বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ অন্তত ২২ বছরের জন্য সৌদি প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে চুক্তির প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় জি-টু-জি-র মাধ্যমে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। টার্মিনাল ব্যবহারের যন্ত্রপাতি সৌদি প্রতিষ্ঠানকেই আনতে হবে।’
বন্দর চেয়ারম্যান এম সোহায়েল বলেন, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে কাজ করবে। চট্টগ্রাম বন্দরেও বিদেশি কোনো অপারেটর প্রথমবারের মতো অপারেশনের দায়িত্ব পাচ্ছে। আমাদের ধারণা, সৌদি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়বে এবং বন্দরের আন্তর্জাতিক মর্যাদাও বাড়বে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে এক হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি নির্মাণ করা হয়েছে। এ নিয়ে বন্দরে টার্মিনালের সংখ্যা হয়েছে চারটি। এর আগে ইউরোপীয় একটি প্রতিষ্ঠান নব্বইয়ের দশকে ‘চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)’ নির্মাণ করে। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ২০০৭ সালে নির্মাণ করে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), যার অংশ দুটি।
পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করেছে দেশিয় প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং। ২০২২ সালের মাঝামাঝি এর কাজ শেষ হয়। এই টার্মিনালসহ চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর জেটির সংখ্যা এখন ২১টি।
চট্টগ্রাম বন্দরের মূল অংশ থেকে ভাটির দিকে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ড্রাইডক ও বোটক্লাবের মাঝে ২৬ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। বহির্নোঙ্গরে আসা মাদার ভ্যাসেলকে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটিতে পৌঁছাতে ১২ নটিক্যাল মাইল অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে পৌঁছাতে অতিক্রম করতে হবে ৬ নটিক্যাল মাইল।
৫৮৪ মিটার লম্বা এ টার্মিনালে তিনটি জেটি আছে। তিনটিতেই একযোগে জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে। দুটিতে আমদানি-রফতানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার জাহাজ এবং ২০৪ মিটার লম্বা আরেক ডলফিন জেটিতে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশ করেছে। কিন্তু পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশের সুযোগ পাবে।
গত বছরের ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই দফায় ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে এনে নাব্য পরীক্ষা করা হয়। এরপরই টার্মিনালটি জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রস্তুত ঘোষণা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পতেঙ্গা টার্মিনাল