নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়েই অবহেলিত কবি নজরুল
১১ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:১৭
ময়মনসিংহ: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে জাতীয় কবির একটি ভাস্কর্য থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকতা মেনেই ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কাজী নজরুলের একটি ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এরপর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ভাস্কর্যের কাজ আর শেষ হয়নি। অথচ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়েছে। এমনটি নির্মাণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান রীতিমতো কাজ গুটিয়ে চলেও গেছে।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বলছে, তাদের যতটুকু কাজ করার কথা ততটুকু তারা করেছে। সেই কাজের টাকাই এখনো পাওনা আছে তারা। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বাকি কাজটুকু করানোর মতো বাজেট মেলানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আদৌ ভাস্কর্যটির কাজ সম্পূর্ণ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষার্থীরা। তারা দ্রুত ভাস্কর্যটিকে পূর্ণাঙ্গ করার দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শুরু হওয়া ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ ২০১৯ সালের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে ২০১৯ সাল কেন, আজ পর্যন্ত সেই ভাস্কর্যের কাজ শেষ হয়নি। এর মধ্যে অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই ২০২১ সালের ২৫ মে কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকীতে ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়েছে। অসম্পূর্ণ ভাস্কর্যের নিচের অংশ সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে এবং লাল গালিচা ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়টির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্নিবীণা হলের পেছনে অবস্থিত নজরুল ভাষ্কর্যটির বেদীর নির্মাণকাজ এখনো অসম্পূর্ণ। এ অবস্থাতেই কাজ গুটিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুতিয়া করপোরেশন। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে কাজ। বাকি থাকা কাজ শেষ করতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বারবার দাবি করলেও বাজেটের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে ভাস্কর্য নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। নজরুলের এই ভাস্কর্যের পাশাপাশি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণের কাজও শুরু হয় একই সময়ে। দুটি ভাস্কর্যের বেদী নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ৪২ লাখ টাকা। পরে সেই ব্যয় বেড়ে হয় এক কোটি ১২ লাখ টাকা। দফায় দফায় ভাস্কর্যগুলো নির্মাণে সময়ও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নজরুল ভাস্কর্যের কাজ এখনো অসমাপ্ত।
জাককানইবি প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, একাধিকবার সময় ও ব্যয় বাড়িয়েও কাজ শেষ না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি আরও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করতে চেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কর্মকর্তাও প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। তবে নির্মাণকাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়ায়। সে অভিযোগ আমলে নিয়ে ২০২১ সালের জুনে এই প্রকল্পে ফের খবর বাড়ানোর ওপর স্থগিতাদেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর থেকেই থমকে আছে নির্মাণকাজ।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুতিয়া করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী জি এম নুরুল করিম স্বপন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার কাজ শেষ। বিভিন্ন কাজ বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এখনো আমি ১০ লাখ টাকা পাব। তারা আমাকে টাকা পরিশোধ করছে না। আমি ওখানে ঢালাই করেছি, ইট লাগিয়ে দিয়েছি। বাকি কাজ বিশ্ববিদ্যালয় যাকে দিয়ে করাতে চায়, তাকে দিয়েই করাক। আমার টাকাটা দিয়ে দিলেই হয়।’
প্রকল্প অসম্পূর্ণ রেখেই কেন কাজ বন্ধ করা হলো— জানতে চাইলে নুরুল করিম বলেন, ‘আমার যতটুকু কাজ করার কথা ছিল, ততটুকু শেষ।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দফতরের পরিচালক প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘পয়সা পেলে করব। এখন টাকা নেই, কাজ করা যাচ্ছে না। এই কাজে মূল বাধা হচ্ছে বাজেট। বাজেট পেলে কাকে দিয়ে করাব, তা দেখা যাবে। আমরা চেষ্টা করছি।’
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, জাতীয় কবির নামে যে বিশ্ববিদ্যালয়, যত সমস্যাই থাকুক, সেখানে সেই কবির ভাস্কর্যটি এভাবে বছরের পর বছর অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকতে পারে না। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদার জন্যই হানিকর। ফলে যেভাবেই হোক, দ্রুত ভাস্কর্যটির কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্নিবীণা হলের প্রাধ্যক্ষ কল্যাণাংশু নাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো কারণে যদি বাজেটের সংকটও থাকে, সেটাকেও ম্যানেজ করা উচিত। কোনো কাজে বাজেট বাড়ানোর সুযোগ থাকলে সেই কাজের খরচ দ্বিগুণ-তিন গুণ হয়ে যায়। এটি বড় সমস্যা। এখানে ঠিকাদারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যেকোনো কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারা যেমন ঠিকাদারের দোষ, তেমনি কাজটি ঠিকভাবে আদায় করে নিতে না পারা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদেরও দোষ। সবাইকেই দায় নিতে।’
এ অবস্থায় আগামী বছরের মধ্যে ভাস্কর্যটির কাজ শেষ করার আশ্বাস দিলেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। তিনি বলেন, ‘এই কাজটি শুরু হয়েছে আমি আসার আগেই। কাজটি কেন শেষ করতে পারেনি, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যে কাজ শেষ করতে পারবে না সেটি শুরু করবে কেন? আমি এই কাজের স্থবিরতা সম্পর্কে অবগত আছি। সামনের বছরই এটির কাজ শেষ করতে চাই।’
সারাবাংলা/টিআর
জাককানইবি জাককানইবিতে নজরুল ভাস্কর্য নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় নজরুল ভাস্কর্য