গোবিন্দগঞ্জে তৈরি হচ্ছে দেশের এক-তৃতীয়াংশ শীতবস্ত্র
১২ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:২৪
গাইবান্ধা: আসন্ন শীতকে লক্ষ্য রেখে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কোচাশহরে মজুদ করা হচ্ছে হাজার কোটি টাকার তৈরি শীতবস্ত্র। চলতি মৌসুমে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার শীতবস্ত্র বিক্রি হবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের। ইতোমধ্যে এখানকার তৈরি সোয়েটার, কার্ডিগান, মাফলার ও মোজাসহ বিভিন্ন শীতবস্ত্র বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত প্রায় চার শতাধিক বিপণি বিতান।
দেশে চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ শীতবস্ত্র উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে পরিচিত গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর। শীত চলে আসায় উপজেলার কোচাশহর ও কামারদহ ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের ছোট-বড় সকল কারখানায় বেড়ে কর্মব্যস্ততা। নিঃশব্দে চলা আধুনিক ডিজিটাল মেশিনে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি তাঁতের খট খট শব্দে মুখর গ্রামের পর গ্রাম। ছয় মাস ধরে উৎপাদিত পণ্যের মজুদের পরও এখনো কারখানাগুলোতে তৈরি হচ্ছে শীতবস্ত্র। রফতানির সুযোগ পেলে সম্ভাবনাময় এই হোসিয়ারি শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করা সম্ভব বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
জেলার গোবিন্দগঞ্জ থেকে মহিমাগঞ্জ সড়ক ধরে যেতে মাঝামাঝি অবস্থান কোচাশহরের। সেখান থেকে ডানে মোড় নিয়ে যেতে হয় দুই কিলোমিটার দূরের নয়ারহাটে। রঙ-বেরঙের সুতোর মিশেলে রকমারি শীতবস্ত্র দিয়ে সাজানো চার শতাধিক দোকান।
গ্রামের একবারে মধ্যখানে গড়ে ওঠা নয়ারহাট নামের শীতবস্ত্রের এই বাজারের শো-রুমগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে সোয়েটার, কার্ডিগান, মোজা, মাফলার, টুপিসহ ১৫০ ধরনেরও বেশি শীতবস্ত্র। বিভিন্ন আকার ও ডিজাইন ভেদে দাম ধরেন ব্যবসায়ীরা। এখানে প্রধানত পাইকারি দরেই বেচাকেনা চলে। সারাদেশ থেকে আসা দোকানিরা এখানকার প্রধান ক্রেতা। তবে খুচরা দামেও শীতবস্ত্র বেচাকেনা হয় এখানে।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর ইউনিয়নের পেপুলিয়া-কানাইপাড়া, মুকুন্দপুর, শক্তিপুর, ধারাইকান্দী, মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের জগদীশপুর, কুমিড়াডাঙ্গা, গোপালপুর, শ্রীপতিপুর, পুনতাইড়, শালমারা ইউনিয়নের উলিপুর, দামগাছা, শালমারা, কলাকাটাসহ বিভিন্ন গ্রামে এসব পোশাক তৈরি হয়। পরে তা নয়ারহাটের চার শতাধিক দোকান থেকে পাইকারদের হাত ঘুরে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
নয়ারহাটের উদ্যোক্তারা জানান, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর মাড়োয়ারিদের কাছে পাওয়া হস্তচালিত দুটি যন্ত্র দিয়ে শুরু হয় কোচাশহরের হোসিয়ারি শিল্পের যাত্রা। কোচাশহর ইউনিয়নের পেপুলিয়া গ্রামে আব্দুর রহিম নামের এক ব্যক্তির সুতি সুতায় বোনা মোজার মাধ্যমে হোসিয়ারি শিল্পের সূচনার মাধ্যমে তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে।
তারা জানান, বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শাওইল থেকে নিয়ে আসা ঝুটের সুতা এখানকার অন্যতম প্রধান কাঁচামাল। মানসম্মত শীতবস্ত্রের জন্য আধুনিক কম্পিউটারাইজড মেশিনে পাশের দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশের দামি সুতাও ব্যবহার হচ্ছে এখন।
ব্যবসায়ী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘গত বছর শীত মৌসুমে গণমাধ্যমে খবর প্রচারের পর নয়ারহাটে মোবাইল নেটওয়ার্ক সঙ্কটের সমাধান হয়েছে। একইসঙ্গে রাস্তাও সংস্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে রাস্তা এতটাই সরু যে, ছোট ছোট যানবাহন ছাড়া বড় ট্রাক চলাচল করতে হয় ঝুঁকি নিয়ে।’
তিনি আরও জানান, নয়ারহাট বা পাশ্ববর্তী কোচাশহরে ব্যাংকের কোনো শাখা চালু হয়নি। কোচাশহরে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট শাখা থাকলেও তা তেমন কাজে আসেনা। প্রতিদিন এই বাজারে কোটি কোটি টাকা বেচাকেনা হলেও ব্যাংক না থাকায় টাকা জমা ও তোলার জন্য ৭-৮ কিলোমিটার দূরে গোবিন্দগঞ্জে বা মহিমাগঞ্জে যেতে হয় এখানকার ব্যবসায়ীদের। এতে ঝুঁকির পাশাপশি ভোগান্তিতেও পড়তে হয় তাদের।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, একইসঙ্গে দুর্ভোগ বেড়েছে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে। ঘনঘন লোডশেডিংয়ের ফলে শ্রমিকদের বেকার বসে থাকতে হয়।
কোচাশহর থেকে পথচলা শুরু করে এখন আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে হোসিয়ারি শিল্প। নারী-পুরুষ মিলে এ শিল্পের সঙ্গে এখন জড়িয়ে আছে লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা। চলতি মৌসুমে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার শীতবস্ত্র বিক্রির আশা ব্যবসায়ীদের। পাশাপাশি দেশে শীতবস্ত্রের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ এখান থেকে পূরণ হয় বলে দাবি করে ব্যবসায়ীরা জানান, রফতানির সুযোগ পেলে সম্ভাবনাময় এখানকার হোসিয়ারি শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করা সম্ভব।
এখানকার শীতবস্ত্র রফতানিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ প্রধান বলেন, ‘ইতোমধ্যে এখানকার কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে। কোচাশহরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা স্থাপনের বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন।’
সারাবাংলা/জিএম/এনএস