‘এমন করে কেউ কাউরে মারতে পারে?’
১৮ মে ২০১৮ ১৬:৩৯ | আপডেট: ১৮ মে ২০১৮ ২০:৪৯
।। জাহিদ-ই-হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।
খুলনা থেকে : হাসপাতালের নারী ওয়ার্ড। বেডে শুয়ে আছেন একজন নারী। মাথায় তার ব্যান্ডেজ বাঁধা। হাতে পায়ে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। মুখে বলছেন দুয়েকটি শব্দ। বেডের পাশে নিষ্পলক বসে আছেন মেয়েটির বোন। থেকে থেকে তিনি কেঁদে উঠছেন। এক বছর আগেও দিব্বি চলাফেরা করতে পারা তার বোন যে এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।
শরীরে এসব আঘাত বয়ে বেড়ানো নারীর নাম সাবিনা খাতুন। তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা বেডে ভর্তি তিনি।
সাবিনা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির একটি বাসায়। দুই সন্তানের মা এই সাবিনা যার বাসায় কাজ করতেন সেই বাসার মালিকের স্ত্রীর নির্যাতনে এমন অবস্থা হয়েছে সাবিনার।
একবছর আগে পেটের দায়ে পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর উপজেলার চরবলেশ্বর গ্রাম থেকে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন সাবিনা। পরিবারে দুই সন্তান, স্বামী, এক বোন আর মা আছে তার। বাবা দেলোয়ার হোসেন গাজী পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন যখন সাবিনার শৈশবকাল। স্বামী মিন্টু তালুকদার রিকশাচালক।
দুই সন্তানের ব্যয়ভার মেটানোর তাগিদেই ধানমন্ডির ৯ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডের একটি বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন সাবিনা। বলতে লাগলেন কাজ করার অভিজ্ঞতা, ‘প্রথম প্রথম ভালো ব্যবহারই করেছে আমার লগে। প্রায় ১০ মাস কাইটা গেলো। এতদিন ঠিকমতো কাজ করতাম। হঠাৎ শরীর অসুস্থ হয়া গেলে কাম করতে কষ্ট হইত। আমার লগে আরেকজন কাম করত। আমি কম কাম করতে পারতাম বইলা ব্যাট (ক্রিকেট ব্যাট) দিয়ে হাতে-পায়ে অনেকক্ষণ ধইরা পিডাইতো।’
কথাগুলো বলতে বলতে জড়িয়ে আসছিল সাবিনার কণ্ঠস্বর। একটু থেমে ফের বলতে শুরু করেন, ‘আমি কতবার কইছি থাহুম না, আমার কথা হুনতো না। মাইরাই যাইতো। কতবার যে অজ্ঞান হইছি ঠিক নাই।’
বলতে বলতে নির্যাতনের দাগগুলো দেখাচ্ছিলেন সাবিনা। গলা-হাত-পা সব জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখাচ্ছিলেন আর কাঁদছিলেন। দু’দিন হলো খুলনা মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
যার বিরুদ্ধে গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ তার নাম রিমা আহমেদ। বাসায় থাকেন তিনি। স্বামী সিদ্দিক আহমেদ টুটুল গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসা করেন। থাকেন ধানমন্ডির ৯ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে।
খোঁজ নিয়ে সারাবাংলার এ প্রতিবেদক রিমা আহমেদ ও তার স্বামীর ছবি বের করেন। ছবিটা দেখাতেই সাবিনা বলেন, ‘হ হ এই মহিলাই সেই মহিলা।’ একাধিকবার এ দম্পতির ছবি দেখানো হয় সাবিনাকে। বারবারই বলছেন, ‘একবছর ওইহানে কাম করছি, কেমনে তাদের চেহারা ভুলুম কন।’
অভিযুক্ত রিমা ও তার স্বামী সিদ্দিক আহমেদ টুটুল
রিমা আহমেদের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও কল ধরেননি তিনি। একাধিকবার কল করার কিছুক্ষণ পর তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সাবিনার চিকিৎসক শওকত উজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, ‘মেয়েটির দুই হাতের হাড় (হিউমেরাস) ভেঙে গেছে। সঙ্গে পায়ের হাড় (ফিমার) ভেঙে গেছে। এছাড়াও হাতের কব্জি, পায়ের কব্জি বেঁকে গেছে। বহুদিন ধরে চিকিৎসা না পেলে হাড়গুলো শক্ত হয়ে বেঁকে যায়। আঘাতগুলো পুরনো। আমরা গুরুতর আঘাতগুলোর অস্ত্রোপচার করব।’
চিকিৎসার পুরো ব্যয়ভার বহন করছে খুলনা মেডিকেল হাসপাতাল। এর আগে শনিবার তাকে পিরোজপুর মেডিকেলে প্রথমে নেওয়া হলে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় খুলনা মেডিকেলে রেফার করা হয়েছে বলে জানান সাবিনার বোন হাফিজা খাতুন।
তিনি সারাবাংলাকে জানান, ‘গত শুক্রবার (১১ মে) মা ঢাকায় যায় সাবিনারে নিয়া আইতে। ওইহানে যাইয়া মাইয়ার চেহারা দেইখা ভয় পায়া যায় আম্মা। নিয়ে আইতে চাইলে মহিলা (রিমা) সাদা কাগজে বইন আর আম্মার স্বাক্ষর লইছেন। হেরপর সাবিনারে পিরোজপুরে লইয়া হাসপাতালে ভর্তি করাইতে চাইছিলাম। হেইখান থেইকা খুলনা মেডিকেলে আইতে কইছে। পরশুদিন (১৫) ভর্তি করাইছি।’
ভুক্তভোগী সাবিনা কিংবা তার পরিবার এখনও এই ঘটনায় মামলা করেননি।
সাবিনার বোন হাফিজা জানান, ‘ভয়েই মামলা করি নাই। আর টাকাও নাই হাতে। ওর জামাই (সাবিনার স্বামী) কোনো খোঁজ রাহে না। কী করুম কিছু বুঝতাছি না। বোনডার জীবন শেষ হয়া গেল। শুধু কইতে চাই, আমরা বিচার চাই। এমন করে কেউ কাউরে মারতে পারে?’
সারাবাংলা/জেএইচ/একে