Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পোশাক রফতানি বাড়লেও প্রবৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কা


১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ১০:৪০

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা :  তৈরি পোশাক খাতে ‘সবুজ কারখানা’ ক্যাটাগরিতে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। চীনকে টেক্কা দিয়ে ডেনিম রফতানিও উঠে এসেছে শীর্ষে। প্রায় ১০ বছর ধরে খাতটির রফতানি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১৩ শতাংশের উপরে থাকলেও সর্বশেষ অর্থবছরে (২০১৬-১৭) তা নেমে আসে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশে, যা এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন।

পূর্ববর্তী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৮ হাজার ৯৪ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হলেও সর্বশেষ অর্থবছরের রফতানি ছিল ২৮ হাজার ১৪৯ মিলিয়ন ডলারের। এতে বছর ব্যবধানে ৫৫ মিলিয়ন ডলারের রফতানি বাড়লেও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া শঙ্কায় পড়েন সংশ্লিষ্টরা। তবে চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রথম প্রান্তিকে রফতানি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উঠে আসলেও শঙ্কা কাটেনি সংশ্লিষ্টদের।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর মতে, বিশ্ববাজারে দিনদিন তাদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ অধিক সরকারি নীতি সহায়তা প্রয়োজন। ‘লিড টাইম’ কমাতে দ্রুত গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণসহ বন্দরের স্বক্ষমতা বাড়ানোর কথাও বলেছেন সংগঠনের এক নেতা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারর্স অ্যান্ড এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলা ডটনেটকে বলেন, ‘সর্বশেষ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি কিন্তু একদমই ছিল না। চলতি অর্থবছরের প্রথম চারমাসে প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়তই তৈরি পোশাকের দাম কমছে। গার্মেন্টের চাহিদা কমছে। বিশ্ববাজারে এখন অনলাইনে অনেক বেশি চাহিদা। অনলাইনে মিটআপ করতে হলে যেটা দরকার শর্ট আর্লি লিড টাইম। আমাদের লিড টাইম অনেক বেশি। পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় আমাদের লিড টাইম বেশি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দর নেই। বন্দরের ক্যাপাসিটি বাড়ানো দরকার। আবার আমাদের এখানে এখনও টেক্সটাইল ফেব্রিক্সের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চীন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আসছে। তাই দ্রুত এখানে টেক্সটাইল মিল হওয়া দরকার। টেক্সটাইলের যে বিরাট চাহিদা আছে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া তা কোনোক্রমেই পূরণ করা সম্ভব নয়।’

প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রায় অভিন্ন কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘গত বছরের প্রবৃদ্ধিটা খারাপ ছিল, যা আমাদের হতাশ করেছে। কিন্তু এই বছরের এই সময়কালে অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুর যে কয়েক মাস, তা যদি আমরা খেয়াল করি, তবে দেখব যে পোশাক খাতের যে প্রবৃদ্ধি তা যথেষ্ট ভালো। কিন্তু পোশাক খাতকে সব সময় নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ, আমরা যে পণ্যগুলো আমেরিকা বা ইউরোপে পাঠাই- সেগুলোর দাম খুব পড়ে যাচ্ছে। একদিকে বায়াররা নানারকম কমপ্লায়েন্স চাচ্ছে, পোশাক খাতের পরিবর্তন চাচ্ছে, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতে বলছে, অন্যদিকে দাম কম দিচ্ছে- কিন্তু এ দুটি বিষয়ের মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে। আমি যদি শ্রমিককে ভালো মজুরি দিতে চাই, ভালো পরিবেশ রাখতে চাই- তাহলে দামটা বেশি পেতে হবে।’

প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এটার নানা কারণ ছিল। গার্মেন্টের অনেক ফ্যাক্টরিতে রিলোকেট করতে হয়েছে। গ্যাস ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্যা হয়েছে, অ্যালায়েন্স অ্যাকর্ডের কারণে রানা প্লাজার পরে যে পরিবর্তন গুলো গার্মেন্ট সেক্টরে এসেছে, সেগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেও সময় লেগেছে।’

বিজ্ঞাপন

তবে তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা আবার নতুন করে জেগে উঠেছে মন্তব্য করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বে তৈরি পোশাকের প্রচলিত ক্রেতা যারা ছিল সেসব দেশের অর্থনীতি একটু ডাল যাচ্ছে বলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা আগের তুলনায় কিছুটা কমে এসেছে। যার জন্য আমাদের পোশাক রফতানিকারকরা বাজার পরিবর্তন করছে। যেমন তারা দক্ষিণ আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ায় যাচ্ছে। নতুন নতুন যায়গা যেটা আগে ছিল না। নতুন জায়গায় যেতে গিয়ে ওখানকার যে সংস্কৃতি, কাপড় ও চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে আবার নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে। যেহেতু এই পরিবর্তনগুলো হয়েছিল সেকারণে এই গতিটা মন্থর হয়েছিল। এখন রফতানিকারকরা নতুন করে আবার জেগে উঠেছে।’

তিনি বলেন, ‘ডেনিম উৎপাদনে আমরা কিন্তু এখন বিশ্বের এক নম্বরে অবস্থান করছি। আগে তো আমরা ডেনিমে এক নম্বরে ছিলাম না; শার্টিং ও টাউজার এইসবে ছিলাম। পোশাক খাতের সবাই যেহেতু সচেতন ও বিশ্ব বাজারের প্রতি ওয়াকিবহাল এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যেহেতু গার্মেন্টে খাতে, যেভাবে ডেনিমে আজকে নম্বর ওয়ান হল, গার্মেন্টের অন্যান্য খাতও একদিন এক নম্বরে পৌঁছাবে।’

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএ’র তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৫ হাজার ৪৯১ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করে, বছরটিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক শূণ্য ৮ শতাংশ। পরের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৯৪ মিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ।

সর্বশেষ অর্থবছরে (২০১৬-১৭) তৈরি পোশাকের রফতানি ছিল ২৮ হাজার ১৪৯ মিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তৈরি পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ১১ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি কমলেও বাকি তিন মাসেই রফতানি বেড়েছে। আর প্রথম প্রান্তিকে লক্ষ্যমাত্রা ৯ হাজার ৩২৩ মিলিয়ন ডলার হলেও রফতানি হয়েছে ৮৪৩৭ মিলিয়ন ডলার।

এদিকে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চারমাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ টি দেশে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। দেশভিত্তিক রফতানির তথ্য থেকে দেখা গেছে, বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরে অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি কমেছে ৫৫ শতাংশ, বেলজিয়ামে কমেছে ২১ শতাংশ। বুলগারিয়ার রফতানি বেড়েছে ৬৫ শতাংশ ও সলভেনিয়ায় ১০৫ শতাংশ। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও কোন কোনটিতে কমেছে, আবার কোনটিতে বেড়েছে।

শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে কথা হয় শীর্ষ শ্রমিক সংগঠন ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কাসের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পোশাক খাতে শ্রমিকদের অবস্থা আগের মতো নেই। বর্তমান সরকারের সময়েই দুইবার মজুরি বেড়েছে। ’১৮ সালে আবার মজুরি বাড়ার কথা রয়েছে। তবে বর্তমানে যে মজুরি আছে, তাতেও শ্রমিকদের জীবন নির্বাহ কষ্ট হচ্ছে। কারণ একই সময়ে সব কিছুরই দাম বেড়েছে।’

স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘পোশাক খাতে শ্রম আইনের বাস্তবায়ন নেই। স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারলে তা যেমন শ্রমিকদের জন্য ভালো হবে তেমনি শিল্পের জন্যেও উপকার বয়ে আনবে।’

খাতটিতে শ্রমিকদের প্রতিবন্ধকতা জানতে চাইলে এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘গার্মেন্ট সেক্টরে চাকরিচুত্যের হার সবচেয়ে বেশি। অধিকাংশ মালিকই তার শ্রমিকদের ১ থেকে ২ বছরের বেশি রাখে না। আমরা চাকরির স্থায়িত্ব চাই।’ এই নেতার মতে, পোশাক খাতের শ্রমিকরা এখনও নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। অধিকাংশ শ্রমিকই ভুগছে অপুষ্টিতে।

আর খাতটিতে আকস্মিভাবে নারীদের শতাংশিক হার কমে যাচ্ছে দাবি করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে পোশাক খাতে নারীদের শতাংশিক হার কমে যাচ্ছে। কারিগরিতে নারীরা দক্ষ নয় বলে অংশগ্রহণ কমছে। এছাড়া খাতটিতে দীর্ঘ সময় কেউ থাকে না। তাই দক্ষ শ্রমিক যেমন বাড়াতে হবে, ঐতিহ্যগতভাবে নারীরা পোশাক খাতে যেমন অংশ নিতেন,  কেন তারা কমে যাচ্ছে- এসব বিষয় নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের ন্যয্য পাওনা পরিশোধ ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে; নতুবা আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।’

তবে সবুজ কারখানা নির্মাণে দেশ অত্যন্ত এগিয়ে গেছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘পোশাক খাতে গ্রিন এনভায়রন্টমেন্টে বাংলাদেশ অত্যন্ত এগিয়ে আছে, পৃথিবীর নম্বর ওয়ান গ্রিন ফ্যাক্টরি বাংলাদেশে, প্লাটিনাম ক্যাটাগরির ফ্যাক্টরিরও আছে বেশ কয়েকটি। এটি নিয়ে এদিকে যেমন অহংকার করতে পারি, অন্যদিকে এটিও মানতে হবে দেশে এখনও বহু প্রতিষ্ঠানে কমপ্লায়েন্সের অভাব রয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বিজিএমইএ ও সরকারের পক্ষ থেকে সেফটি ইস্যুতে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, অগ্নি ও ভবনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গত সাড়ে ৪ বছর অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স ও ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের আওতায় কাজ করে, আমাদের কারখানাগুলো বর্তমানে যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে; এখন আমরা বলতে পারি- বিশ্বে আমাদের কারখানাগুলোই সবচেয়ে নিরাপদ। নতুন যে ফ্যাক্টরিগুলো হচ্ছে সেগুলোও কিন্তু গ্রিন কনসেপ্টে হচ্ছে।’

তবে নতুন স্থানে বিজিএমইএ ভবনের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে অসম্মতি জানান তিনি।

সারাবাংলা/এএইচটি/একে

 

পোশাকখাত বিজিএমইএ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর