সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন চায় মহিলা পরিষদ
১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৩৯
ঢাকা: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, আসন সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি এবং নির্বাচরি এলাকা পুনর্নির্ধারণের প্রতিশ্রুতিসহ ৩৪টি সুপারিশ জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এজন্য সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বাতিলের দাবি জানিয়েছে তারা।
মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘বর্তমান পরিস্থিতি, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
তিনি বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান পরিস্থিতিকে জটিল ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা ও সহিংসতা সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করছে। ২০২২ সালে চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন এবং বর্তমান সময়ে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’
সংগঠনটির সভাপতি ফওজিয়া মুসলেম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে সমঅধিকারসহ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার থাকতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা অভিযোগ করেন, দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন আইন থাকার পর নানাভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। এবং নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে হলে সব রাজনৈতিক দলকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে যথাযথ কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এ প্রেক্ষিতে মহিলা পরিষদ ৩৪টি সুপারিশ তুলে ধরে।
রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে নারী-পুরুষের সমঅধিকারসহ অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার থাকতে হবে।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে
- জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, আসন সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি এবং নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে থাকতে হবে। এজন্য সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
- গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ২০২৩ এর আলোকে সকল রাজনৈতিক দলের সকল কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারীদের অর্ন্তভুক্তির বাধ্যবাধকতা নির্বাচনি ইশতেহারেও থাকতে হবে।
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে
- নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরি বৈষম্য দূর করে কৃষি এবং অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে সমকাজে সম মজুরি নিশ্চিত করতে হবে।
- বিদ্যমান বাজারব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।
- সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার প্রদানের অঙ্গীকার ইশতেহারে থাকতে হবে।
- নারীর গৃহকর্মের এবং সেবামূলক কাজের আর্থিক মূল্যায়নের মাধ্যমে তার স্বীকৃতি প্রদান এবং তা জিডিপিতে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে
- নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণের মাধ্যমে ধর্ষণসহ সকল প্রকার নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলের অঙ্গীকার নির্বাচনি ইশতেহারে থাকতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ডিজিটাল স্পেসে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে।
- মানবাধিকার এবং সমতার আলোকে বৈষম্যমূলক সকল আইনের প্রয়োজনী সংস্কার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অন্য কোন বিষয় বিবেচনা করা যাবে না।
- অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে।
- জাতিসংঘ ঘোষিত সিডও সনদের ২ ও ১৬(গ) ধারায় সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে এবং সিডও-এর আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
- নারীর অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করার জন্য সমাজে নারীর প্রতি যে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে তা প্রতিরোধ করার উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
- বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করাসহ রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বাল্যবিবাহ আইনের বিশেষ শর্ত বাতিল করতে হবে।
- মাদক নির্মূলের প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে থাকতে হবে।
সাম্প্রদায়িকদা ও নারী বিদ্বেষী মনোভাব প্রতিরোধ
- সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর নারী অধিকারবিরাধী এবং নারীবিদ্বেষী প্রচার-প্রচারণা এবং কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সকল প্রকার ডিজিটাল স্পেসে এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেসকল সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয় তা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
- সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
- নির্বাচন পূর্ববতী, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে নারীসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রতি থাকতে হবে।
- ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।
- রাজনৈতিক কৌশলের নামে কোনক্রমেই রাজাকার, জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী, স্বৈরাচার, ঋণখেলাপি, নারী নির্যাতনকারী, মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, গডফাদারদের সাথে কোনো প্রকার ঐক্য গড়ে না তোলা এবং তাদেরকে মনোনয়ন দানে বিরত থাকতে হবে।
- সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, দলিতসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সংরক্ষণ
- প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত নারীর (দলিত, হরিজন, পথভাসী, যৌনকর্মী,তৃতীয় লিংগ) ক্ষমতায়ন এবং অধিকার রক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
- আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
- পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রতি থাকতে হবে।
- প্রতিবন্ধী নারীদের উন্নয়নের মূল ধারায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠমো এবং অন্যান্য উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া অধিকারে
- একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, জেন্ডার সংবেদনশীল, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ প্রেম ও মানবাধিকারের মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা পাঠক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সকল প্রকার মৌলবাদী অপপ্রচার ও বাধা প্রতিরোধ করতে হবে।
- নারী ও কন্যার যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিষেবা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
- ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে করতে হবে এবং ক্রীড়াঙ্গনে বিদ্যমান নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
- বাঙালি এবং আদিবাসী সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে।
- যুবসমাজের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
গণতন্ত্র ও সুশাসন
- দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার ও সকল মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রতি নির্বাচনী ইশতেহারে থাকতে হবে।
- মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যমসহ সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, শক্তিশালী ও কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
- নারীর মর্যাদা বিষয়ক কমিশন গঠন করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
- দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করতে হবে।
সারাবাংলা/আরএফ/পিটিএম