ভাতা পাচ্ছেন না অর্ধশতাধিক মানুষ, তালিকায় তারা মৃত!
১৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০৯
কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে ভাতা সুবিধাভোগীর তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা সমাজসেবা অধিদফতরের সাবেক এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়মমাফিক হয়েছেন বলে দাবি ওই কর্মকর্তার।
জানা যায়, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষা শ্যামপুর গ্রামের মৃত নগেন চন্দ্র পালের মেয়ে সবিতা রাণী। জায়গা জমি না থাকায় একজনের সুপারির বাগানে সামান্য একটু জমিতে ছাপড়া ঘর করে বসবাস করছেন একাই। একসময় সবিতা রাণীর জমি-জমা সব ছিল। কিন্তু স্বামী শসীমোহন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় চিকিৎসা করতে সব শেষ। তার স্বামী মারা গেছেন বছর দশের আগে। এরপর দুটি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজেই কাটাচ্ছেন নিঃস্ব জীবন। ভিক্ষাবৃত্তি আর অন্যের বাড়িতে কাজ করে চলছে তার জীবন।
একই অবস্থা প্রতিবেশী মৃত মানিক চন্দ্র পালের স্ত্রী গোলাপী রাণীরও। কিডনি রোগে আক্রান্ত স্বামী এবং একমাত্র মেয়ে ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত মারা যায় বেশ কয়েক বছর আগে। যেটুকু জমি ছিল সেগুলো চিকিৎসার পেছনে বিক্রি করে এখন নিঃস্ব। এখন এক শতক জমিতে দুটি টিনের ঘর করে কোনো রকমে ভিক্ষাবৃত্তি করেই দিন কাটছে তারও।
একই ইউনিয়নের নয়াগ্রামের মৃত গহরের মেয়ে আশি বয়সোর্ধ্ব গোলেনুর বেওয়া বিধবা ভাতা পেতেন ২০০৮ সাল থেকে। কিন্তু তাকে মৃত দেখিয়ে প্রায় আড়াই বছর আগে বিধবা ভাতার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগ করেও নাম অর্ন্তভুক্ত করতে পারেননি। বাস্তবে এখনও জীবিত থাকলেও কাগজ-কলমে তিনি মৃত।
ওই ইউনিয়নের হাতিয়া ভবেশ গ্রামের বাসিন্দা বিধবা আনোয়ারা বেওয়া জীবিত হয়েও তিনি এখন মৃত উপজেলা সমাজসেবার বিধবা ভাতার তালিকায়। ফলে প্রায় দুবছর ধরে তিনি ভাতাবঞ্চিত হয়ে আছেন। এই বিষয়ে অফিসে যোগাযোগ করেও কোনো ফল পাননি সুবিধাভোগীরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে উপজেলা সমাজসেবা ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পে ১৮ জন ভিক্ষুককে জনপ্রতি ১৪ হাজার করে মোট দু’লাখ ৫২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরমধ্যে সাহেবের আলগা ইউনিয়নের সাতজন, দলদলিয়া ইউনিয়নের চারজন, হাতিয়া ইউনিয়নের তিনজন, ধামশ্রেণী ইউনিয়নের তিনজন এবং গুনাইগাছ ইউনিয়নের একজন।
তবে উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে ভাতা ভোগীর তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন হাতিয়া ইউনিয়নের সবিতা রাণী এবং গোলাপী রাণী, সোনারীপাড়ার ৮ নং ওয়ার্ডের মৃত তমেজ উদ্দিনের ছেলে মজিবর রহমান, গুনাইগাছ ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি গ্রামের ৮ নং ওয়ার্ডের হাসেন আলীর মেয়ে হাছেনা বেগম, ধামশ্রেণী ইউনিয়নের উত্তর বিজয়রাম গ্রামের ৯নং ওয়ার্ডের ইব্রাহিমের ছেলে ছামছুল হুদা,ওই ওয়ার্ডের বিজয় তবকপুর গ্রামের বরকত আলীর মেয়ে বরিতন বেগম, ৮নং ওয়ার্ডের পশ্চিম দরিচর পাঁচপাড়া গ্রামের পনির উদ্দিনের ছেলে নুরুজ্জামান, সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সাহেবের আলগা গ্রামের মধু মোল্লার মেয়ে জামিরন নেছা, ৪ নং ওয়ার্ডের সোনাভানের মেয়ে তারিপ জান, সোনা উল্ল্যা মেয়ে সাহেরা খাতুন, ৫নং ওয়ার্ডের উত্তর নামাজির চর ছাবেদ আলীর মেয়ে বাতাসী বেগম, জেহাত এর মেয়ে রমেচা খাতুন, নেছাব উদ্দিনের মেয়ে শাহেরা খাতুন, ওসমান গণির মেয়ে সুকুরজান বেগম, দলদলিয়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের উত্তর দলদলিয়া গ্রামের আশরাফ উদ্দিনের নুরজাহান বেগম, সাহেবের কুটি গ্রামের বাশারতের মেয়ে আছমা খাতুন, ৫নং ওয়ার্ডের মিয়াজি পাড়ার আমির উদ্দিনের ছেলে হাজির উদ্দিন এবং কেতাব উদ্দিনের মেয়ে কাছুয়ানী বেগম। ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পের তালিকায় নাম থাকলেও টাকা কিংবা সহায়তা জোটেনি তাদের ভাগ্যে।
সবিতা রাণী বলেন, ‘আমি উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে কোনো টাকা-পয়সা পাইনি। ভিক্ষা করে দিন কাটছে। টাকার খোঁজ কীভাবে পাব?’
গোলাপী রাণী বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার কথা বলে নয়ন নামে এক ছেলে ফোন নম্বার ও ভোটার আইডি নিয়ে যায়। তার কিছুদিন পরে টাকা না দিয়ে একটি কম্বল দিয়ে গেছে। আমি কোনো টাকা পাইনি।’
বঞ্চিত বিধবা ভাতা ভোগী গোলেনুর বেওয়া বলেন, ‘২০০৮ সালে জুলাই মাস থেকে আড়াই শ টাকা ভাতা পাওয়া শুরু করি। কিন্তু প্রায় আড়াই বছর থেকে সেই ভাতা আমার বন্ধ হয়ে আছে। অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমাকে মৃত দেখিয়ে ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। এরপর অনেক টাকা-পয়সা খরচ আর দৌড়ঝাঁপ করেও ভাতাপ্রাপ্ত হতে পারিনি।’
অভাবের সংসারে ছেলেরা রিকশা চালিয়ে খায়। জিনিসপত্রের যে দাম তাতে করে ছেলেদের সংসার চলে না। আমার এখন ওষুধ এবং টুকটাক খরচ কীভাবে চালায় তারা। এখন জীবিত হয়েও সমাজসেবা অফিসের কাগজে মারা গেছি।
আনোয়ারা বেওয়ার সন্তান সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমার মা জীবিত অথচ উপজেলা সমাজসেবা অফিসে ভাতার তালিকায় সে মৃত। বহু দৌড়ঝাঁপ করেছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্রায় দু’বছর পার হলো ভাতা বন্ধ হয়ে আছে। যে অফিসার এই কাজগুলো করেছেন তিনি তো বদলি হয়ে গেছেন।’
সিদ্দিকের অভিযোগ- সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উৎকোচের মাধ্যমে জীবিত ব্যক্তিদের মৃত দেখিয়ে অন্যদের ভাতাভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
হাতিয়া ইউনিয়নের হাতিয়া ভবেশটারী পাড়ার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা সেবা অফিস থেকে ভিক্ষুক তালিকায় ৮ নং ওয়ার্ডের ভিক্ষুক মজিবর রহমানের নাম দেওয়া হয়েছে তা ভুল। এ ছাড়া বাকি যে আটজনের নাম তালিকায় রয়েছে তারা কেউই ভিক্ষুক নন।’
হাতিয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি এম আবুল হোসেন বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান থাকাকালীন ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্প সম্পর্কে জানতাম না। আমার সময় কোনো ভিক্ষুক সেই টাকা পেয়েছে- এমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তৎকালীন সমাজসেবা অফিসার বলতে পারবেন কাকে কীভাবে এই টাকা বিতরণ করেছেন।’
উপজেলার ভিক্ষুক পুনর্বাসন কমিটির সাবেক সভাপতি মহিউল ইসলাম মুকুল হাজি বলেন, ‘আমার উপজেলায় কোনো ভিক্ষুককে সমাজসেবা থেকে কোনো অর্থ বা অনুদান দেওয়া হয়নি।’
এই বিষয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া এবং তালিকাভুক্ত ভিক্ষুকরা টাকা না পাওয়ার বিষয়টি তিনিও অবগত আছেন বলে জানান। সঠিক তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি বাদ দেওয়া ভাতা ভোগীদের পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভিক্ষুকদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
উলিপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান ভিক্ষুকদের টাকা না পাওয়া এবং ভাতাভোগী অনেক জীবিত ব্যক্তিদের মৃত দেখিয়ে নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগ মৌখিকভাবে পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এই বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযাগ করেনি। লিখিত অভিযোগ দিলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করব।’
অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ‘সময়মতো অনলাইনে নিবন্ধন করতে না পারায় অনেকের তালিকা থেকে নাম বাদ গিয়ে পরিবর্তন হয়েছে।’
ভিক্ষুকরা ভাতা না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি তো এখন বদলি হয়ে গিয়েছি। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছিল।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মশিউর রহমান ২০১৯ সালের ১ জুলাই উলিপুর উপজেলায় প্রথম যোগদান করেন। পরে তিনি ২০২১ সালে মাদকসহ রংপুর র্যাব-১৩ এর হাতে আটক হলে তাকে একইবছর ১৫ ডিসেম্বর বরখাস্ত হন। এরপর ২০২২ সালের ২১জুন তিনি স্ব-পদে আবারও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি ওই বছর ১৪ নভেম্বর বদলি হয়ে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলায় চলে যান।
সারাবাংলা/একে