নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত বিএনপির অর্ধশত নেতা!
১৮ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৫৮
ঢাকা: বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে ধারাবাহিক হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। পাশাপাশি দলের অখণ্ডতা রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। ভাঙন রোধে সব রকম চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তারা। তবে, শেষ রক্ষা হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
জানা গেছে, বিএনপির অন্তত অর্ধশত নেতা নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। এরইমধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দুইজন নির্বাহী সদস্য ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’-এর ব্যানারে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের দাবি, বিএনপির অন্তত ১২৫ জন নেতা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
কেবল ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ নয়, নির্বাচন করতে আগ্রহী বিএনপি নেতাদের জন্য আরও অন্তত পাঁচটি প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত রয়েছে। কেউ নির্বাচন করতে চাইলে ওইসব প্ল্যাটফর্মে ভিড়তে পারবেন। তফসিল ঘোষণার আগে থেকে বিএনপির ৬০ থেকে ৭০ জন নেতাকে টার্গেট করে এসব প্ল্যাটফর্মের উদ্যোক্তারা নানা মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে ৪০/৫০ জনের কাছ থেকে এরইমধ্যে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
জানা গেছে, যেসব নেতা বিএনপিতে নিজেদের বঞ্চিত বা অবহেলিত মনে করেন এবং শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি ক্ষুব্ধ, তারা চাচ্ছেন বিকল্প প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচনে গিয়ে অবহেলার প্রতিশোধ নিতে। এ ছাড়া যেসব প্রবীণ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এবার নির্বাচন বর্জন করলে পরের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা থাকবে না, তারাও যে কোনো একটা প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে বিএনপির কিছু উঠতি নেতাও নির্বাচনে যেতে আগ্রহী।
বিএনপির এসব নেতা ইতোমধ্যেই তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট (বিএনএফ) এবং স্বতন্ত্র গণতান্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
প্রয়াত নাজমুল হুদার দল তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে বিএনপির বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির বড় বড় অনেক নেতা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা নিজ নিজ আসনে নির্বাচন করবেন। এসব নাম এখন প্রকাশ করতে চাই না। দুয়েক দিনে মধ্যেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
দলীয় সূত্রমতে, নির্বাচন কমিশনে নতুন নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নিয়ে বেশি চিন্তিত বিএনপির হাইকমান্ড। কারণ, ২০২১ সালের ৭ জুলাই গঠিত বিএনএম-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুর রহমান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এবং দলটির সদস্য সচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য।
জানা গেছে, বরগুনার বেতাগী থানা বিএনপির সভাপতি ছিলেন আব্দুর রহমান। বর্তমানে তিনি প্রাইম ইউনির্ভাসিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রধান ও ডিন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্দুর রহমান। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও তিনি হেরে যান। এরপর বিএনপির রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
মেজর (অব.) মো. হানিফ ২০২১ সালের ২৮ জুন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সে সময় হঠাৎ হানিফের দল ছাড়ার ঘটনাকে ইঙ্গিতপূর্ণ বলেছিলেন বিএনপির নেতারা। দল ছাড়ার ১০ দিনের মাথায় নতুন দল বিএনএম গঠন করেন তিনি। হানিফের সংসদীয় এলাকা সিরাজগঞ্জ-২। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।
বিএনএম গঠনের সময় থেকেই বিএনপি নেতারা ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ খুঁজে পাচ্ছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত হিসেবে দেখছিলেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। তাদের আশঙ্কা ছিল, বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে বিএনএম-এর ব্যানারে বিএনপির একটি অংশকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করবে সরকার। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিএনএম নিবন্ধন পাওয়ায় সেই আশঙ্কা আরও ঘনিভূত হয়।
সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘অনেকেই লাইন ধরে আছেন তৃণমূলে (তৃণমূল বিএনপি) যোগ দেওয়ার জন্য। আর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজের নেতৃত্বে আরও একটি দল হতে যাচ্ছে। তারা শিগগিরই ঢাকায় কনভেনশন করবে। সুতরাং বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও নেতাদের অংশগ্রহণ ঠেকাতে পারবে না।’
মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর ধারণা করা হয়েছিল- মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিএনএম-এর দায়িত্ব নিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে বিএনপির একটি অংশ বিএনএম-এর প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে। হাছান মাহমুদের বক্ত্যের একদিন পর সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন মেজর (অব.) হাফিজ। যদিও তার বক্তব্যে আস্থা রাখতে পারছে না বিএনপি। দলটির অধিকাংশ নেতা মনে করেন, মেজর (অব.) হাফিজকে দিয়ে বড় ধরনের একটা গেম খেলবে সরকার।
এদিকে, গত বুধবার (১৫ নভেম্বর) রাজধানীর মালিবাগে স্কাই সিটি হোটেল লাউঞ্জে ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’-এর ব্যানারে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট খন্দকার আহসান হাবিব ও ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম। তাদের দাবি, বিএনপির অন্তত ১২৫জন নেতা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দল থেকে তাদের বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
খন্দকার আহসান টাঙ্গাইল-৫ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেন। তিনি জানান, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম ঝালকাঠি-২, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ট্রাস্টি স্বপন সরকার রাজবাড়ী-১ এবং ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম মিন্টু টাঙ্গাইল-৮ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানো এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে বিএনপি থেকে নেতাদের বের করে আনার চেষ্টা করছে সরকার। বিএনপির দলছুট, ধর্মভিত্তিক দল, আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ও জাতীয় পার্টিসহ মিত্রদের সব মিলিয়ে ৭০ থেকে ১০০টি আসনে ছাড় দেওয়ার চিন্তা আছে সরকারের। এরই অংশ হিসেবে আলাদা আলাদা পাঁচ/ছয়টি প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিএনপি নেতাদের এসব প্ল্যাটফর্মে ভিড়িয়ে নির্বাচন করানোর চেষ্টা চলছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের তৎপরতার খবর মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি। তবে, বিএনপির যেসব নেতা সত্যিকার অর্থে দলকে ভালোবাসে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে, তারা সরকারের ফাঁদে পা দেবে না। এর পরও ভয়ে বা লোভে পড়ে দুয়েকজন যদি যায়, তাতে বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না।’
সারাবাংলা/এজেড/ইআ