নতুন শহীদ মিনার নিয়ে ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা
১৮ নভেম্বর ২০২৩ ২২:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাংস্কৃতিক বলয়ের আওতায় চট্টগ্রামে নতুনভাবে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নিয়ে আপত্তি তুলেছেন বিভিন্ন অঙ্গনের সংস্কৃতিকর্মীরা। তাদের বক্তব্য, সংস্কার ও নতুনভাবে নির্মাণের নামে শহীদ মিনারটিকে ‘লোকচক্ষুর আড়ালে’ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উঠানামার পথ সংকুচিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, আবেগ এবং নান্দনিকতা- কিছুই নতুন এ স্থাপনায় ফুটে ওঠেনি বলে তাদের অভিযোগ।
শনিবার (১৮ নভেম্বর) সকালে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনার পরিদর্শন করেন। এসময় মেয়র তাদের সামনের বিজয় দিবসে এ শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু সংস্কৃতিকর্মীরা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ছাড়া এ শহীদ মিনারে ফুল দিতে তাদের আপত্তির কথা তুলে ধরেন।
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মাহফুজুর রহমানসহ বিভিন্ন অঙ্গনের একদল বিশিষ্টজনকে নিয়ে শহীদ মিনার পরিদর্শনে যান মেয়র। এরপর মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে সংস্কৃতিজনদের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসেন।
২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরীর কে সি দে রোডে মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ভেঙে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স বা সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণ করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে গণপূর্ত বিভাগ। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এর কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের অধীনে আছে, মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ও পাবলিক লাইব্রেরির অংশের পুরনো স্থাপনা ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ও আটতলা অডিটরিয়াম ভবন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংস্কার, ২৫০ জন ধারণক্ষমতার একটি উন্মুক্ত গ্যালারিসহ মুক্তমঞ্চ এবং ক্যাফে ও মিনি মিউজিয়াম। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন।
২০২১ সালের অক্টোবরে আগের শহীদ মিনার ভাঙ্গার আগে সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। তারা দাবি করেছিলেন, বর্তমান অবয়ব ঠিক রেখেই সংস্কার করতে হবে। তখন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, শহীদ মিনারের মূল নকশার কোনো পরিবর্তন করা হবে না।
কিন্তু সংস্কারকাজ শেষে পরিদর্শনের পর নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার সারাবাংলাকে বলেন, ‘শহীদ মিনারের আগের অবয়ব ঠিক আছে। কিন্তু আগে যে রাস্তা কিংবা আশপাশের এলাকা থেকে মাথা উঁচু করে থাকা শহীদ মিনারটা আমরা দেখতাম, সেটা আর নেই। এক কথায়, শহীদ মিনারের বিশালতাটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স একটা বিশাল স্থাপনা, কিন্তু পুরো স্থাপনার মধ্যে শহীদ মিনারটা একেবারে ছোট হয়ে গেছে। দুইদিকে ব্লক করে ফেলা হয়েছে।’
‘আগের চেয়ে অনেকবেশি উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে। এত সিঁড়ে ভেঙ্গে উপরে উঠতে হচ্ছে যে, বয়স্ক কিংবা শারীরিকভাবে যাদের প্রতিবন্ধকতা আছে, তাদের জন্য রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। ঢাকার যে শহীদ মিনার কিংবা আমাদের আগেরটা, বড় স্পেস, অনেকে একসঙ্গে উঠতে-নামতে পারত। এখন সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাহলে আমাদের জাতীয় দিবসগুলোতে যে একসঙ্গে হাজার, হাজার লোক হয়, তারা কিভাবে যাবে-আসবে?’
তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের উপরে শহীদ মিনার করেছে, কিন্তু সেটা নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে না, তাহলে লাভ কী হল ? যিনি নকশা করেছেন এবং যারা বাস্তবায়ন করেছেন ও তদরাকি করেছেন, তারা কেউই সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে পারেননি।’
জানা গেছে, সভায় আবুল মোমেনও শহীদ মিনার নিয়ে আপত্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের শহীদ মিনারকে হিজাব পরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তো একটি মুক্ত স্থাপনা চেয়েছিলাম। আগের মতো একই অবয়বে একটি স্থাপনা চেয়েছিলাম। এভাবে ইট-পাথরে ঢাকা শহীদ মিনার আমরা চাইনি। এটা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।’
ডাক্তার মাহফুজুর রহমান, আহমেদ ইকবাল হায়দার, আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরী, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশ গুপ্তা, সাংস্কৃতিক সংগঠক দেওয়ান মাকসুদ আহমেদও সভায় প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
শীলা দাশ গুপ্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে যে শহীদ মিনার ছিল সেটি আমরা রাস্তা থেকেই দেখতাম। এখন সেটা রাস্তা শুধু নয়, আশপাশের এলাকায় বিল্ডিংয়ের ছাদে দাঁড়ালেও দেখতে কষ্ট হচ্ছে। তিনতলার সমান সিঁড়ি বেয়ে উঠে ফুল দিতে হবে আবার নামতে হবে। নামার স্থান এতটাই সংকুচিত যে, শত শত মানুষ কিভাবে নামবে জানি না।’
‘শহীদ মিনার তো শুধু একটা ইট-পাথরের স্থাপনা নয়, এর সঙ্গে আমাদের আবেগ-অনুভূতি জড়িত। কিন্তু যিনি আর্কিটেক্ট, তিনি এটির নকশা করার সময় সেই অনুভূতিকে গুরুত্ব দেননি। তিনি কর্পোরেট স্টাইলে ইট, লোহা, সিমেন্ট দিয়ে একটা স্থাপনা নির্মাণ করে দিয়েছেন মাত্র।’
সংস্কৃতিকর্মীদের বক্তব্য শুনে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী শহীদ মিনারে বয়স্কদের ওঠার উপযোগী করে সিঁড়ি নির্মাণ এবং পথচারীরা যাতে সহজে সেটি দেখতে পান, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
সভায় চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ জানিয়েছেন, সংস্কৃতিকর্মীদের আপত্তির বিষয়টি তিনি উর্দ্ধতন পর্যায়ে তুলে ধরবেন।
নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আমাদের আপত্তির বিষয়টি জানিয়েছি। বিজয় দিবসে আমাদের পক্ষে এই শহীদ মিনারে ফুল দেয়া সম্ভব হবে না, এমনও কেউ কেউ বলেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা আছেন, উনারা বিষয়গুলো নোট করেছেন। ২ ডিসেম্বর আরেকটি সভা হবে। দেখা যাক, সেখানে কি সিদ্ধান্ত আসে।’
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইন্দুনন্দন দত্ত, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলম, কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী, গাজী মো. শফিউল আজিম ও আবদুস সালাম মাসুম, বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি আব্দুল হালিম দোভাষ ও সাধারণ সম্পাদক প্রনব চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা ও সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি তপন চক্রবর্তী, চসিকের উপসচিব আশেকে রসুল চৌধুরী টিপু, সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি শাহ আলম নিপু, সাংস্কৃতিক সংগঠক শারমিন হোসেন, সুচরিত দাস খোকন, শেখ শওকত ইকবাল, প্রদীপ খাস্তগীর, নূরনবী মিলন, অনন্য বড়ুয়া, অলক মাহমুদ, মাহফুজুর রহমান, চন্দন পাল, অসীম বিকাশ, প্রকল্প পরিচালক লুৎফুর রহমান, গণপূর্ত অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বদরুল আলম খান সভায় উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, সংস্কার কার্যক্রমের জন্য নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে গত দুই বছর ধরে জাতীয় দিবসগুলো পালিত হয়ে আসছিল।
সারাবাংলা/আরডি/একে