কুড়িগ্রামে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ‘অচিন বৃক্ষ’
২৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০৮
কুড়িগ্রাম: কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরিচয়হীন একটি গাছ। যুগের পর যুগ ডাল পাতায় ঘেরা বিশাল আকৃতির গাছটি রোজ বেড়ে উঠছে, অথচ গাছটির নাম কেউই জানে না! এমন একটি গাছের দেখা মিলেছে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ওমর মজিদ ইউনিয়নের জয়দেব হায়াত গ্রামে মৃত দর্পণ নারায়ণের বাড়িতে।
নির্দিষ্টভাবে গাছের নাম না জানলেও লোক মুখে গাছটি ‘অচিন বৃক্ষ’ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়দের ধারণা, এই অচিন গাছটি ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গাছটির বয়স কমপক্ষে ৫০০ বছর হবে। বৃটিশ আমলেই ‘অচিন বৃক্ষ’ হিসেবে গাছটির নামকরণ করা হয়। একসময় গাছের শাখা-প্রশাখা প্রায় ২০ শতক জমি জুড়ে বেশ বিস্তীর্ণ ছিল। কিন্তু ক্রমাগত কেটে ফেলার কারণে গাছের বর্তমান শাখা-প্রশাখা কমে গেছে। বর্তমানে গাছটি ১০ শতাংশেরও কম জমির আয়তন ঘিরে রয়েছে।
গাছটিতে গোটা গোটা ফল ধরে এবং এসব ফল পশু-পাখি খায়। তবে গাছ থেকে ফল মাটিতে পড়লেও কোনো ফল থেকে নতুন গাছ জন্মায় না। অনেক আগে গাছে বিশাল আকৃতির বিষাক্ত সব সাপ বসবাস করতো। কিন্তু এসব সাপ মানুষের ক্ষতি করেনি বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সম্প্রতি ‘অচিন গাছ’ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জেলার ঐতিহ্য এই দর্শনীয় স্থানের অনেক জায়গা ইতিমধ্যে দখল হয়ে গেছে। গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পার্শ্ববর্তী ও দূর-দূরান্তের সনাতন ধর্মের লোকজন মানত করে গাছটির গোড়ায় এসে পূজা-অর্চনা করে দান বাক্সে দক্ষিণা দেন। দান বাক্সে লেখা রয়েছে গাছটির পাতা কেউ ছিঁড়বেন না।
বর্তমানে অযত্ন, অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গাছটির চারদিক জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়েছে। গাছটির পাতা সবুজ। তবে পাতাগুলো ডুমুর পাতার মতো হলেও তত খসখসে নয়, মসৃণ। সারা বছর ধরে গাছে পাতা দেখতে পাওয়া যায়। পুরনো পাতাগুলো রাতারাতি নতুন পাতায় রূপান্তরিত হয় বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।
অচিন গাছের পাতার রস সাদা বর্ণের। সারা বছর গাছটি সুশীতল ছায়া দিয়ে থাকে। কালের সাক্ষী হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আজও জবুথবুভাবে দাঁড়িয়ে আছে এ গাছটি।
বর্তমানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের রক্ষণাবেক্ষণ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। প্রায় ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে রাজারহাট উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গাছটির গোঁড়া পাকা করে দেওয়ার পর কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে ২০১৬ সালে গাছটির চারপাশ সৌন্দর্যবর্ধন করে। কিন্তু আধুনিকভাবে সংস্কার না করা আর যত্নের অভাবে সেগুলো নষ্ট হওয়ার পথে।
রূপকথার মতো গাছটিকে ঘিরে স্থানীয়দের লোকমুখে নানা গল্পকথা শোনা যায়। অনেকের ধারণা, বর্তমান ভারতের আসাম রাজ্যের কামরূপ-কামাখ্যা থেকে আগত একদল জাদুকর এ গাছটি চোখের পলকে উড়িয়ে এনে বর্তমান স্থানে লাগিয়ে দেন। গাছটির নাম কেউ জানতেন না। তখন থেকেই এ গাছটি ‘অচিন বৃক্ষ’ নামে পরিচিত।
আরেক কাহিনী থেকে জানা যায়, কোনো এক অজানা পীর সুদূর পশ্চিম দিক থেকে গাছটির চারা এনে এখানে রোপণ করেছিলেন। সে কারণেই গাছটি কেউ চিনছেন না। তবে গাছের যে একটি ঐতিহাসিক রহস্য রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘Ficus lacor Buch-Ham’ দাবি করে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন বলেন, “অচিন গাছটির নাম শুরুতে সবার কাছে অজানা ছিলো। আমি গত ৫-৭ বছর ধরে গাছটির নাম অনুসন্ধান করার জন্য এর নমুনা সংগ্রহ করে নিশ্চিত হই গাছটির নাম রয়েছে। গাছটি মরীচি পরিবারের ফিকাস গণভুক্ত একটি গাছ। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘Ficus lacor Buch-Ham’ (ফিকাস ল্যাকর বুক-হাম)। গাছটি দেখার জন্য দুর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে। গাছটির আশপাশ সংস্কার করার জন্য কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”
রাজারহাট উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কাবেরী রায় বলেন, ‘আমি গাছটি পরিদর্শন করেছি। গাছের আশপাশ পরিস্কার করে সৌন্দর্যবর্ধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/জেডআইজেড/এমও