ফারুককে হটাতে চান ডালিয়া, বিএনপিতে দেবর-ভাবি-ভাগ্নের লড়াই
২২ নভেম্বর ২০২৩ ১২:০৮
রাজশাহী: পদ্মা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এক বিখ্যাত জেলার নাম রাজশাহী। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা। এর পরিচিতি রেশম দিয়ে। রাজশাহীকে বলা হয়ে থাকে সিল্কসিটি। এছাড়াও এই জেলা শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত। তবে ইদানিং রাজশাহীকে আমের রাজধানীও বলা হয়ে থাকে। রাজা ও জমিদারদের কারণে এই জেলার নামকরণেও ছাপ রয়েছে। এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলো বহন করে চলছে রাজা ও জামিদারদের ঐতিহ্য।
৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সবধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনে যে জেলার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে সেটি রাজশাহী। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামানের জন্মভূমি এই রাজশাহী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এই জেলা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। রাজশাহী থেকে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু, প্রয়াত সাঈদউদ্দিন আহমেদ, প্রয়াত আবুল হোসেন, মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি, প্রয়াত মনোয়ারা রহমান ও আবদুর রাজ্জাক। এই জেলায় পাকবাহিনীর হাতে প্রথম শহিদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহা। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই জেলার অনেক মানুষ শহিদ হয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে মারা হতো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের। স্বাধীন দেশে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর জেলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাজশাহীর সন্তান জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান।
রাজশাহীকে এক সময় বলা হতো বিএনপির ঘাঁটি ও মৌলবাদীদের আস্তানা। তবে পিছিয়ে ছিল না প্রগতিশীল আন্দোলনও। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। মূলত তখনই রাজনীতি থেকে অবস্থান হারাতে শুরু করে বিএনপি। সে সময় রাজশাহীর ছয়টি আসন থেকে পাঁচটিতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। আর একটিতে জয় পায় ওয়ার্কার্স পার্টি। বর্তমানে রাজশাহীতে বিএনপি তার অবস্থান হারিয়েছে। এই সময়ে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচনে বিশাল শক্তি নিয়ে মাঠে নামবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
রাজশাহীর ছয়টি আসন থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এই জেলার কয়েকটি আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। বিএনপির প্রার্থীর সংখ্যাও কম নয়। তারাও কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন কিনেছেন অনেকে। এর আগে তারা মিছিল-মিটিং, শোডাউন, পথসভা উঠান বৈঠক করেছেন। এবারও জাতীয় পার্টি মহাজোটে থেকে নির্বাচন করছে। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে রাজশাহী-১ (তানোর ও গোদাগাড়ী) আসনের চিত্র।
বরেন্দ্র অঞ্চলের তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-১ আসন। ঐতিহ্যবাহী এই আসনটিতে এক সময় সংসদ সদস্য ছিলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান হেনা। রাজশাহীর এই আসনটি এক সময় জামায়াতের দখলেও ছিল। পরে তা বিএনপির হয়ে এখন আওয়ামী লীগের দখলে এসেছে। তবে আসনটিতে জামায়াত এখনো বেশ শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে।
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-১ আসনে মনোনয়ন দৌড়ে আছেন আওয়ামী লীগের সাত জন, বিএনপির তিন জন, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের একজন করে। এদের অনেকেই জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি শিল্প প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। এ ছাড়া রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি তিনি। তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে।
সর্বশেষ কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে সমালোচিত হন ওমর ফারুক চৌধুরী। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে রেষারেষি, নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে বিভিন্ন পদে বসানো, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজের আত্মীয় ও অনুসারীদের মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সখ্যতার খবরও মানুষের মুখে মুখে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ এর এক প্রতিবেদনেও মাদকসংশ্লিষ্টায় তার নাম এসেছে।
তবে এবারে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন লড়াইয়ে তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য আয়েশা আক্তার জাহান ডালিয়া। তিনি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী। তিনি গোদাগাড়ীর বাসিন্দা। তিনি এই আসনের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন।
বর্তমান সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় নেতা আয়েশা আক্তার জাহান ডালিয়ার বাইরেও এবার এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইবেন- সাবেক ডিআইজি ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মতিউর রহমান, তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মুণ্ডুমালার সাবেক পৌর মেয়র গোলাম রাব্বানী, জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান আক্তার, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম আসাদুজ্জামান আসাদ ও জেলা কৃষকলীগ সভাপতি অধ্যক্ষ তাজবুল ইসলাম। মনোনয়ন চাওয়া বেশিরভাগ নেতাই চান ফারুক চৌধুরীকে হটাতে।
অন্যদিকে, রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ভাই মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিন বিএনপি থেকে প্রার্থী হবেন বলে গুঞ্জন আছে। তিনি গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির তিন নম্বর সদস্য। ওই কমিটিতে আছেন আমিনুল হকের স্ত্রী আভা হক। তিনি এক নম্বর নির্বাহী সদস্য পদে আছেন। আর আমিনুল হকের ভাগ্নে মাহফুজুর রহমান মিলনও ওই কমিটির দুই নম্বর নির্বাহী সদস্য। তারা সবাই রাজশাহী-১ আসন থেকে বিএনপির কাছে মনোনয়ন চাইবেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
এদিকে, বিএনপির একাধিক নেতা জানান, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে ব্যাপক ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তাদের। ধরপাকড়ের কারণে বেশিরভাগই নেতারা গা ঢাকা দিয়েছেন। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা ছাড়া তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন করবেন না।
রাজশাহী-১ (তানোর ও গোদাগাড়ী) আসনে প্রার্থী হবেন অধ্যাপক মজিবুর রহমান। একসময় তিনি জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির পদে ছিলেন। তিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় জামায়াত ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত নায়েবে আমির। ১৯৮৬ সাল তানোর-গোদাগাড়ী আসনের এমপিও ছিলেন তিনি।
জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতা জানান, ক্ষমতাসীন দলের দমন-পীড়ন ও চাপের কারণে এতদিন প্রকাশ্যে না এসে গোপনেই নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত ও শক্তি বৃদ্ধিতে নিয়োজিত ছিলেন তারা। রাসিক নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থী দাঁড় না করালেও এ নির্বাচনে দুজন নারী কাউন্সিলর ও ৯ জন পুরুষসহ মোট ১১ জন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল জামায়াত। রাজশাহীর ছয়টি আসনের মধ্যে রাজশাহী-১, ৩ ও ৬ আসনে বেশ শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছে তাদের। তবে রাজশাহী-১ আসনে ভিত্তি বেশ মজবুত। এই আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থীকে জেতাতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন জামায়াতের সূরা সদস্য থেকে সাধারণ কর্মী ও সমর্থক বাহিনী।
রাজশাহী-১ আসনে জাতীয় পার্টির (জাপা) নমিনেশন পাবেন অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন। তিনি জাপার রাজশাহী জেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। গোদাগাড়ী পৌরসভার গত নির্বাচনে তিনি মেয়রপ্রার্থী ছিলেন।
মনোনয়ন প্রসঙ্গে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারা সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা ভালো কাজ, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক, এলাকায় ভালো অবস্থান ও সৎ নেতাদের কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। রাজশাহী-১ আসন থেকে কে সংসদ সদস্য তাও ঠিক করবে কেন্দ্র। আমরা তৃণমুল থেকে যাচাই করে একটি প্রতিবেদন দেবো। এর পরে সিদ্ধান্ত নেবে।’
রাজশাহী জেলা বিএনপি সদস্য সচিব অধ্যাপক বিশ্বনাথ সরকার বলেন, ‘এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। তাই রাজশাহী-১ আসন থেকে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ যদি নির্বাচন করে তার বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেবে।’
উল্লেখ্য, রাজশাহী-১ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৮৩ হাজার ২৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৭২ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৮২ জন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি ওই সময় ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এম এনামুল হক পান ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৫০ ভোট। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের টিকিট পান ওমর ফারুক চৌধুরী। ওইবার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ওমর ফারুক। ওই নির্বাচনে তিনি ২ লাখ ৩ হাজার ৪৭৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ব্যারিস্টার আমিনুল হক পান ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৮ ভোট।
সারাবাংলা/এমই/পিটিএম
অধ্যক্ষ তাজবুল ইসলাম আভা হক আয়েশা আক্তার জাহান ডালিয়া ওমর ফারুক চৌধুরী গোদাগাড়ী গোলাম রাব্বানী তানোর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মতিউর রহমান মাহফুজুর রহমান মিলন মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিন রাজশাহী-১