তেরশ্রী গণহত্যা দিবস: ৪৩ শহিদ পরিবারের দাবি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
২২ নভেম্বর ২০২৩ ১০:১২
মানিকগঞ্জ: দিনটি ছিল শুক্রবার। শীতের কাকডাকা ভোর। সেই ভোরেই নিরীহ ঘুমন্ত গ্রামবাসীর ওপর হামলে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গ্রাম। এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তারা। শিশু থেকে বৃদ্ধ— সবার আর্ত চিৎকারে ভারী হয়ে উঠে তেরশ্রী গ্রামের আকাশ-বাতাস।
সেদিন তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানকে কলেজ আঙ্গিনায় নিয়ে গুলি করে ও বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তেরশ্রী এস্টেটের জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায় প্রসাদ চৌধুরীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় শরীরে পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত পুড়িয়ে। পর্যায়ক্রমে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ঢুকে একে একে ৪৩ জন স্বাধীনতাকামী মানুষকে হত্যা করে সেই বর্বররা।
এমন ঘটনাই ঘটেছিল ৫২ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রীতে। আজ সেই ২২ নভেম্বর, তেরশ্রী গণহত্যা দিবস। ভয়াল সেই দিনের কথা মনে পড়ে আজও আঁতকে ওঠেন অনেকেই।
সেই ভয়াবহতার শিকার যে পরিবারগুলো, সেই শহিদ পরিবারগুলোর চরম দুর্দশায় মানবেতর দিন কাটালেও দেখার কেউ নেই। তারা এখনো প্রত্যাশা করছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির। নারকীয় সেই ঘটনার বিবরণ সংরক্ষণে স্থানীয়দের দাবি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পাঠাগার আর জাদুঘর নির্মাণের।
যুদ্ধের সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে করে এখনো আঁতকে ওঠেন গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যাওয়া নেপাল ঘোষ। সেদিন দুহাত জোর করে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ক্ষমা চাইলেও গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছিল তাকে। প্রাণে বেঁচে গেলেও বুলেটের ক্ষত এখনো বহন করছে তার শরীর।
অন্যদিকে নেপাল ঘোষ বেঁচে থাকলেও জীবন কাটাতে হচ্ছে চরম দুর্দশায়। অন্যের জায়গায় জরাজীর্ণ এক কুঁড়ে ঘরে কোনোমতে থাকছেন। এক বেলা খাবার জুটলে অভুক্ত থাকতে হয় আরেক বেলা। নেপালের আক্ষেপ, যুদ্ধাহত হয়েও তার কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। মিললে হয়তো একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারতেন।
হানাদার বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ। তার বৃদ্ধ স্ত্রী শোভা রানীও বেঁচে আছেন চরম অভাব সঙ্গী করে। শোভা রানী বলেন, ‘২২ নভেম্বর আসলেই খালি আমাদের কথা স্মরণ করা হয়। অনেকে কথা বলে, খোঁজ নেয়। আর সারাবছর কেউ খোঁজ রাখে না আমরা কীভাবে বেঁচে আছি।’
জ্ঞানের ঘোষের কলেজ পড়ুয়া নাতনি শিলা ঘোষ আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আমার দাদা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তার পরিবার তো কিছুই পায়নি। অন্তত তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও আমরা সেটা গর্ব নিয়ে বলতে পারব।’
নিহত তেরশ্রী এস্টেটের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায় প্রসাদ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে সাবেক স্কুলশিক্ষক সমেশ্বর রায় চৌধুরী বলেন, আমার বাবাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। বাবার গায়ের চাদরে পেট্রোল ঢেলে দেয়। এর পর আগুন ধরিয়ে জীবন্ত হত্যা করে। এক পাশবিক ইতিহাস তৈরি হয় সেদিন।
সমেশ্বর চৌধুরী বলেন, ‘আমি সেই শহিদদের উত্তরসূরী। আমাদের চাওয়া— এই স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত থাকুক। আর বাবার মতো যারা শহিদ হয়েছেন, তাদেরও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া হোক। আমাদের চাওয়া এটুকুই।
আরেক শহিদ পরিবারের সদস্য নশের ঘোস জানালেন, তার বাবাকেও পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করে। তার বাবার এই জীবনদানেরও কোনো স্বীকৃতি দেয়নি কোনো সরকারই। নশের বলেন, ‘বহু আবেদন করেছি। অনন্ত একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে এখনো আবেদন করে যাচ্ছি। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। এই স্বীকৃতি না থাকলে হয়তো তেরশ্রী গণহত্যার ইতিহাস হারিয়েও যাবে।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনার রশিদও জানালেন, ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর গণহত্যায় যারা শহিদ হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই অসহায় পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের দাবি দীর্ঘ দিন ধরে করে যাচ্ছি। এ ছাড়া শহিদদের স্মরণে তেরশ্রী গ্রামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি পাঠাগার স্থাপনের দাবি রয়েছে এলাকাবাসীর। আশা করব, এই দাবি পূরণ করবে সরকার।’
ঘিওরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তেরশ্রী গ্রামের স্বাধীনতাকামী ৪৩ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারের পক্ষ থেকে শহিদ পরিবারের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এখানকার শহিদ পরিবারগুলোও যেন সেগুলো পায়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সারাবাংলা/টিআর
একাত্তরে গণহত্যা গণহত্যা তেরশ্রী গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধ শহিদ পরিবার শহিদ পরিবারের স্বীকৃতি দাবি